যাই হোক এই কাণ্ডের পরও যে কাজটা তখন মার এবং আমার কাছে ভয়ানক খারাপ এবং অক্ষমনীয় মনে হয়েছিল এবং আমরা দুজনেই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে, বাবা ওদের সঙ্গে কিছু খারাপ ব্যবহার করলেন না। এমন কি রবিঠাকুরের কাছে নিয়ে যাবার যে কথাটা ছিল সেটাও স্থির রাখলেন। আমি তার কাছে এদের জাদুবিদ্যার গল্প করেছিলাম। উনিও এদের দেখবার জন্য ব্যগ্র হয়েছিলেন। অলৌকিক অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস
থাকলেও রবিঠাকুর মনে করতেন সব বিষয়েই পরীক্ষা করে দেখবার চেষ্টা করা উচিত। সেটাই বৈজ্ঞানিক। অনুসন্ধান করব না কেন? তাই একটা দিন ঠিক হয়েছিল রুশ-দম্পতিকে নিয়ে যাবার জন্য।
“বাবা, আমি ওদের সঙ্গে যাব না, লোকটা ভারি বিশ্রী—”
“তা কি হয় মা—সব ঠিক হয়ে আছে এখন তুমি না গেলে কবি কি ভাববেন? তাছাড়া জীবনে কত রকম অবস্থায় কত রকম মানুষের সঙ্গে দেখা হবে, নিজের শক্তিতে বুদ্ধিতে সব সময়ই তুমি ঠিক পথে স্থির থাকবে, এ তো আমি জানিই। জগতে খারাপ লোক আছে বলে কি তুমি গর্তে ঢুকে থাকবে?”
দুপুরবেলা বাবা ও আমি রুশ-দম্পতিকে নিয়ে কবির কাছে গেলাম—ওদের দোতলার পাথরের ঘরে বসিয়ে আমি তিন তলায় ওকে খবর দিতে গেলাম। পাথরের সেই ঘরটা চোখের সামনে ভাসে—নিচু নিচু চৌকিতে গদীগুলি জাপানী মাদুর দিয়ে মোড়া আর কুশনগুলিও জাপানী মাদুরের। ঐ ঘরের পরে বহু পরিবর্তন দেখেছি—ঐ ঘরেই তাঁর শেষ নিঃশ্বাস পড়েছে। উপরে গিয়ে দেখি তিনি তৈরী হয়েই আছেন, একটা কাগজে কয়েকটা প্রশ্ন লিখে নিয়ে কাগজটা বইয়ের মধ্যে পুরে উঠে দাঁড়ালেন, “চল জাদুকরীকে দেখা যাক।” ঘোরান সিড়ি দিয়ে আমরা নেমে এলাম। ওরা অপেক্ষা করছিল, দু-চার কথার পর মেয়েটি চোখে কাপড় বাধল, তার স্বামী এসে ওর নাড়ি ধরল। মেয়েটি কিছু বলতে পারল না কিন্তু সে যে চেষ্টা করছে বোঝা গেল। কবি তো ওদের অপ্রস্তুত করতে চান না, ব্যাপারটা বুঝতে চান, তিনি বলতে লাগলেন—“কি করলে সুবিধা হবে—আমি যদি কাগজে লিখি সুবিধা হবে?” মেয়েটি বললে, “হতে পারে।” উনি তখন কাগজে লিখে কাজগটা উল্টে রাখলেন। তবুও কিছু হয় না। মেয়েটির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হল। সে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারী করতে লাগল—তারপর বারান্দায় চলে গেল—“There is a wall before me, there is a wall before me—আমার সামনে একটা দেওয়াল, সামনে একটা দেওয়াল” বলতে বলতে বারান্দায় দৌড়াতে দৌড়াতে আরো জোরে জোরে বলতে লাগল—“আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না”, তার কপালের ঘাম ঝরে পড়ল, নিঃশ্বাস দ্রুত হল, তারপর ঐ রকম বলতে বলতে ঘরের বাইরে এসে সিড়ি দিয়ে নেমে গলি দিয়ে দৌড়ে চলে গেল—ওর হতবুদ্ধি স্বামীও ওর পিছন পিছন ছুটল, চিৎপুরের রাস্তায় সাহেব মেমের এই দৌড় দুপাশের দোকানদারেরা কি রকম উপভোগ করছে ভেবে আমার হাসি পেয়েছিল খুব। আমি মুখে কাপড় দিয়ে হাসছি। বাবা বললেন, “তুই এখানে থাক। আমি ওদের পৌঁছে দিয়ে আসি।” কবি আমাদের পিতা-পুত্রীর বুদ্ধির উপর যথেষ্ট কটাক্ষ করলেন এবং অধ্যাপকদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কি প্রত্যাশা করা যায়, তাও বললেন। এদিকে বাবাও ক্ষুব্ধ, তার ক্ষোভের কারণ ওরা কবির কথা বলতে পারল না, আর তাঁরটা পারল! রুশ জাদুকরের উপাখ্যান এইভাবে শেষ, হল।
***
.২ মির্চা ইউক্লিড আমাদের বাড়ি আসত
এই সব ঘটনা যখন চলছিল, তখন মির্চা ইউক্লিড আমাদের বাড়ি আসত কিন্তু সে সময়ে তাকে লক্ষ্য করি নি। আমার সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে বলেও মনে পড়ে না। যেদিনের কথাটা মনে আছে সেটা একটা বিকেল। বাবা তার লেখবার টেবিলে বসেছিলেন। আর উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বাবার দিকে মুখ করে সে বসেছিল। বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন—“এই আমার মেয়ে অমৃতা, এই আমার ছাত্র মির্চা ইউক্লিড”–সে উঠে দাঁড়াল। আমি ওকে একপলক দেখলাম। ওর চোখে পুরু চশমা, চুল হালকা, চোয়াল উঁচু, মুখ চৌকো। বিদেশীদের এই অভ্যাসটা আমার খুব ভাল লাগে, মেয়েদের দেখলে ওরা উঠে দাঁড়ায়। আর আমাদের ছেলেরা? হয় তো পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবে, নয় তো ন্যাকামি করবে, বা এমন ভাব করবে যেন মেয়েদের উপস্থিতি টেরই পাচ্ছে না।
বাবা বললেন, “ইউক্লিড যেখানে থাকে সেখানে ওর খুব অসুবিধা হচ্ছে তাই আমি ওকে এখানে থাকতে বলছি, ওর জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দাও।”
এক মুহূর্তের জন্য আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল, আমি বললাম—“বাবা বাড়িতে আবার একজন ইংরেজ কেন?” বাবা আমার আপত্তিতে বেশ একটু বিরক্ত হলেও খুব সাবধানে বাংলায় বললেন—“এ ইংরেজ নয়, ইউরোপের একটা ছোট্ট দেশের মানুষ। আর ইংরেজ হলেই বা কি, এই তোমার শিক্ষা হল?”
এইবার আমি মির্চা ইউক্লিডের দিকে তাকালাম। বিদেশী নাম সম্বন্ধে আমার তখনও কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। নইলে হয়তো নাম শুনেই বুঝতাম যে ওটা অ্যাংলো–স্যাক্সন নাম নয়—যা হোক চেহারা দেখে বুঝলাম এ ইংরেজ নয়। রঙ যদিও সাদা, চুল কালোই, লালচে নয়,ব্যাকব্রাশ করা, কপালের দুধার দিয়ে উঠে গেছে। গালের হাড় উঁচু, একটু পাহাড়ীদের মতো। সে চকিতে একবার আমার দিকে চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
আমার আপত্তি অবশ্য ঠিক ইংরেজ বলে ছিল না, কিন্তু এটা বলাই ভালো মনে করে বলেছিলাম। এ সময়ে বিদেশীদের যাতায়াত ও কলকাতার ‘এলিট’দের সঙ্গে মেলামেশার জন্য আমাদের বাড়ির সাজগোজ বদলান হচ্ছিল একটু একটু করে। এ বিষয়ে আমিই অগ্রণী ছিলাম, মা এসব একেবারেই পারতেন না। বাবা আর আমি এগবার্ট এজ নামে একটা নীলামের দোকান থেকে নিত্য নূতন আসবাব নিয়ে আসতাম। দিল্লী কানপুরের পিতলের জিনিস পালিশ করা, দরজার হাতল থেকে ছিটকিনি পর্যন্ত, আমাকেই করতে হতো। এই বাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ আমাদের মতো আধাসাহেবী বাড়িতে যথেষ্ট কষ্টকর ছিল। একে তো বাড়িতে অনেক লোক, তাছাড়া গ্রাম থেকে যখন তখন গ্রাম্য আত্মীয়স্বজন রোগের চিকিৎসা করাতে, গ্রহণের গঙ্গাস্নান করতে, কালীঘাটে পূজো দিতে উপস্থিত হতো সদলবলে। আমার মা কাউকে ফেরাতেন না। রোগ নিয়ে কেউ এলে মা সুপটু নার্সের মতো তাদের সেবা করতেন। মার নিজের কোনোদিন কালীঘাটে যাবার ইচ্ছা ছিল না। মার বাপের বাড়ি সম্পূর্ণ ব্রাহ্মভাবাপন্ন—কিন্তু গ্রামের কোনো বৃদ্ধা আত্মীয়া এলে আমাদের শেভরলে গাড়ি করে প্রতিদিন তাকে কালীঘাট পাঠাতেন—গাড়ি করে ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল আনতেন। মার দরজা সর্বদা সবার জন্য খোলা থাকত। কিন্তু এর ফলটা আমার পক্ষে খুব ভালো হতো না। কারণ আমি অল্প কিছুদিন হল একলার জন্য একটি ঘর পেয়েছি। অবশ্য সম্পূর্ণ একলা নয়—এ ঘরে আমার সঙ্গে রাত্রে শান্তি এবং আমার এগার বছরের ছোট বোন সাবিত্রী অর্থাৎ ‘সাবি’ শুততা। কিন্তু ঘরটা আমারই—আমি ঐ ঘর সুন্দর করে সাজিয়েছি। সব নিচু নিচু আসবাব করেছি—খাটের পা কেটে সেটা নীচু করা হয়েছে। আসবাব অবশ্য সামান্যই। সাদা কালো দাবার ছকের মতো পাথরের মেঝে, পালিশ করা। ধূপ আর ফুলে সর্বদা সুগন্ধি রাখতাম সে ঘর। যে কেউ আসত, বলত—ঘর তো নয়, মন্দির। মাঝখানের দেওয়ালে রবিঠাকুরের একটা ছবি ছিল—মাথায় টুপি পরা—সেই ছবিটা আমার ভারি আশ্চর্য লাগত, ঘরের যে কোণেই তুমি থাক, মনে হবে তোমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এড়াবার পথ নেই।