যদিও বাবার বাঙালী ছাত্রদের সঙ্গে বেশি কথা বলার সাহস হতো না কিন্তু বিদেশী ছাত্রদের সম্বন্ধে অন্তরে এ বাধা অনুভব করতাম না। বাবাও অনায়াসে ইয়োরোপীয়দের সঙ্গে মিশতে দিতেন। এই সময়ে এক রুশ-দম্পতি কলকাতায় এসেছিল। তারা গ্লোবে নানারকম জাদুবিদ্যা দেখাচ্ছিল। তাদের নিয়ে শহরে খুব সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বাবা বললেন, “চল, বুজরুকিটা দেখে আসি”—গ্লোব থিয়েটারে স্টেজের উপর চোখে কালো রুমাল বেঁধে আভূমিলুণ্টিত কালো গাউন পরে একটি সুন্দর মহিলা এসে দাঁড়াতেন, আর তার স্বামী দশকদের ভিড়ের মধ্যে নেমে আসতেন। ভদ্রমহিলা দর্শকদের বলতেন প্রশ্ন করতে। দর্শকদের মধ্যে থেকে দাঁড়িয়ে উঠে কেউ প্রশ্ন করলে তার সুবেশ তরুণ স্বামী সেই ব্যক্তির নাড়ি ধরতেন, তখন মহিলাটি স্টেজের উপর থেকে তাঁর অনুচ্চারিত প্রশ্ন এবং উত্তর গড়গড় করে বলে যেতেন। প্রশ্নগুলো কখনো ঠকাবার জন্য করা হতো, কখনো বা কোনো মর্মান্তিক গোপন খবর জানবার জন্য। যেমন, একজন উঠে দাঁড়াতেই চোখবাধা মহিলাটি বললেন, তুমি জানতে চাও তোমার পকেটে যে দেশলাইয়ের বাক্সটা আছে তাতে ক’টা কাঠি আছে? বাহান্নটা!’ কিংবা ‘তুমি জানতে চাও তোমার স্ত্রী তোমার প্রতি অবিশ্বাসিনী কি না? তিনি তো ঠিকই আছেন, তুমিই অবিশ্বাসী এই না শুনে সারা হলসুদ্ধ লোকের উচ্চ হাসিতে ভদ্রলোক অপ্রস্তুত। বাবা বললেন, “এই মেয়েটা তো জাহবাজ, একে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে।”
আজকাল, অর্থাৎ এই উনিশ শ শতকের শেষের দিকে এদেশে যে রকম অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতের দিকে ঝোক হয়েছে উচ্চবিত্ত শিক্ষিত সমাজেও, আমাদের সময় যতদূর মনে পড়ে এটা কম ছিল। এখন ঘরে ঘরে ছবি থেকে ভস্ম পড়ে, অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিসপত্রর আবির্ভূত হয়, এসব গল্প বিদ্বান বৈজ্ঞানিকেরাও সহজে বলেন, তখন তা হতো না। শিক্ষিত লোকেরা কোনো আজগুবি অতিপ্রাকৃত ঘটনা বিশ্বাস করতে ইতস্তত করতেন, অন্তত মনে মনে যাই হোক মুখে তা স্বীকার করতেন না। আমার বাবাও যে একেবারে কুসংস্কারমুক্ত ছিলেন তা নয়, কিন্তু তার প্রকাশ্য মন তা স্বীকার করত না। অতএব পরীক্ষা করবার জন্য ঐ রুশ-দম্পতিকে নিমন্ত্রণ করা হল। বাবার ধারণা দর্শকদের মধ্যে ওদেরই লোক ছিল। আমি বললুম, “তাহলে তুমি কিছু জিজ্ঞাসা করলে না কেন?”
“বাবারে, যা জাহবাজ মাইয়া, কি জানি কি কইয়া দিব!”
আমাদের বাড়িতে চায়ের বৈঠকে বেশ কয়েকজন প্রতিষ্ঠাবান ব্যক্তি এলেন, অধ্যাপক, লেখক ইত্যাদি, চায়ের সঙ্গে এই মজার খেলা চলতে লাগল। ভদ্রলোক নাড়ি টিপে ধরেন, ভদ্রমহিলা তার মনের কথা বলে দেন। অবশেষে আমার পালা এল, আমি ভাবলাম একটু ফঁাকি দেবার চেষ্টা করা যাক, বাংলা কথা কি করে বলবে? মনে মনে বললাম, “আমার শেষ কবিতাটার নাম কি?” ভদ্রমহিলা ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে বললেন, “ভোগপাত্র”—উচ্চারণবিকৃতি ছিল কিন্তু বলেছিলেন ঠিকই। একজন তরুণ অধ্যাপক বললেন, “থট্রিডিং ছাড়া আর কিছু নয়।”
বাবা বললেন, “বেশ, তাতেই সব ব্যাখ্যা হয়ে গেল নাকি?”
এই রুশ-দম্পতিকে নিয়ে আমরা একদিন এম্পায়ার থিয়েটারে ইটালীয়ান অপেরা দেখতে গেলাম। বাবা, মা, আমি ও ওরা দুইজন। সেই সময়ে এদেশে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতে কান অভ্যস্ত ছিল না—সাধারণত তা শেয়াল কুকুরের চীৎকার বলেই অভিহিত হতো। এখন ট্রানজিস্টারের কল্যাণে বস্তির রোয়াকেও জাজ সঙ্গীত তো বাজছেই, বীঠোভেনও বাজছে। তখন এটা কল্পনাতীত ছিল। দু-তিন পুরুষ ধরে যারা পাশ্চাত্য শিক্ষায় তামিল পেয়েছেন, যাদের বলা হতো ইঙ্গবঙ্গ সমাজের লোক, তাঁদেরই বাড়িতে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের চর্চা হতো, মেয়েরা টুং-টাং পিয়ানো বাজাতেন—অতিথি অভ্যাগত, বিবাহোপযোগী পাত্র এলে ড্রয়িংরুমে পিয়ানো বাজিয়ে বৃষ্টির পরিচয় দিতেন, কিন্তু সেটা একেবারে শিশুসুলভ ব্যাপার ছিল। অতএব বোঝাই যাচ্ছে ইটালীয়ান অপেরা আমার কাছে খুব একটা উপভোগ্য হচ্ছিল না। কিন্তু জানি সে কথা কাউকে বলব না, কারণ এই তো সবে এসব জায়গায় আসছি। এতে বড় হয়ে ওঠার গৌরবটা অনুভব হচ্ছে। তাছাড়া নিজেকে বেশ বোদ্ধা প্রমাণ করতেই চাই, অজ্ঞ বলে নয়। যাই হোক, অন্যমনস্কভাবে অপেরা দেখছি যেন ওষুধ খাচ্ছি। হঠাৎ ঐ রুশ ভদ্রলোক, তখন তাকে অ-ভদ্রলোকই বলব, দক্ষিণ হাতটি বাড়িয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলেন। আমি তো আঁতকে উঠলাম। যদিও এসব বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতা যথেষ্ট ছিল তবু স্বাভাবিকভাবে আমরা ঠিক মতোই ব্যবহার করতাম। আমি এক ঝাকানি দিয়ে তার হাতটা সরিয়ে দিলাম, আবার যেন স্প্রিং-দেওয়া কলের মতো সে ব্যক্তি সেটি ফিরিয়ে আনল। ভাবলুম কি করা যায় এখানে তো চেঁচামেচি করা যাবে না। নিচু হয়ে পায়ের নাগরাটা খুলে আস্তে আস্তে ওর হাঁটুর উপর রাখলাম, এবার সেও আঁতক উঠল, আমি খুব ধীরে ধীরে বললাম, “তোমাকে জুতো মারব।” তখন স্পিংটা অন্যদিকে কাজ করল, সে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিল। বাড়ি ফিরে এই গল্পটা বলাতে, মা বাবার উপর ভারি রেগে গেলেন, যাকে তাকে এতটা বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বাবা খুব হাসছেন। পাশ্চাত্য জগৎটা তিনি চিনতেন ভালোই, তাই একটুও আশ্চর্য হন নি। মাকে বলতে লাগলেন, “অমৃতাকে নানা অবস্থায় নানা লোকের সঙ্গে মিশতে শিখতে হবে, ও তো তোমার মতো ঘরে বসে থাকবে না। যদি একটু চেষ্টা করে ও একদিন সরোজিনী নাইডু হবে।”