“হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো মাছের ঝোল ভাত খেয়ে এসেছি।”
আর বলতে হবে না, যা সন্দেহ হয়েছিল তার নিরসন হল, “দ্যাখো নার্স, তুমি ব্রাহ্মণের বিধবা, মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে এসেছ, মৃত্যুকালে তুমি আর আমার মুখে জল দিও না মা, আমার বৌমাকে ডেকে দাও।”
বৌমাও ছুটে এলেন, “সারাজীবন ওর সেবা করলাম। আর এখন এই শেষ সময়ে মনোকষ্ট দেওয়া—আমার যা হয় হবে।”
ঠাকুমা চলে যাবার পর এ বাড়ির চেহারা বদলে গেল ভিতরে ও বাইরে। ব্ৰত পূজা, কালীঘাট, পুরোহিত, ছুঁৎমার্গ, এটো প্রভৃতি বিরাট বিরাট সমস্যা যা সারাদিন মাকে হয়রান করত, সব যেন এক ছুঁয়ে উড়ে গেল। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত জঞ্জালের তূপ সরিয়ে আমরা নূতন দিগন্তের দিকে মুখ ফেরালাম।
আমার এ পরিবর্তন খুব ভালো লাগছিল। আমি শৈশব থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে যতই এগোচ্ছি ততই ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষদের দেখতে পাচ্ছি। আমাদের মফঃস্বলের বাড়িঘরের চেয়ে এঁদের বাড়িঘর আচার-আচরণ কত না পৃথক! তখন একটা কথা শুনতাম ‘এলিট’ এখন যেমন শুনি বুর্জোয়া’। বুর্জোয়া’ কথাটার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব আছে, কেমন যেন ঝগড়ার আভাস পাওয়া যায়, এলিট’ তা নয়। আরো একটা কথা শুনতাম ‘ক্রিম অফ ক্যালকাটা’, এখন তো দুধে সরে মিশে একাকার। এই উচ্চ সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার তের বছর বয়স থেকে বাবা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতেন, আমি যাতে তাকে আমার কবিতা দেখিয়ে নিই সেজন্য। আমি কোনোরকমে সেই কাজটা সংক্ষেপে সেরে তার কবিতা তাকে আবৃত্তি করে শোনাতাম, আমি খুব ছেলেবেলা থেকে কবিতা আবৃত্তি করতে ভালোবাসি। আমার মুখে নিজের কবিতা শুনতে রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে আমাকে উৎসাহ দেবার জন্য তিনি বলতেন, “তুমি আমার চেয়েও আমার কবিতা ভালো পড়”—জানি এ কথা আমাকে খুশি করবার জন্যই তবু আমার মন পূর্ণ হয়ে যেত কানায় কানায়, আমি ভাবতাম, এর কাছ থেকে আমি কত পাই, এখানে একবার এলে এর অস্তিত্বের আস্বাদই কি মধুর—কিন্তু আমার তো ওকে দেবার কিছুই নেই। এই একটি জিনিসই দিতে পারি। তাই যদিও সেই বিরাট প্রতিভার সামনে আমার সঙ্কোচ ও লজ্জার অন্ত ছিল না, অনেক সময় মুখ তুলে কথাও বলতে পারতাম না, কিন্তু কবিতা আবৃত্তি শুরু করলে আমার লজ্জা, ভয়, সঙ্কোচ কেটে যেত। মনে আছে একবার ‘সোনার তরী’, ‘কৌতুকময়ী’, ‘জীবন দেবতা, ‘হৃদয় যমুনা’ আবৃত্তি করছি পর পর-উনি মৃদু মৃদু হাসছেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—“এসব কবিতা তুমি বুঝতে পার?”
আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ঘাড় নাড়লাম ‘হা’—তারপর সোনার তরীর নিহিতার্থ, জীবন দেবতার দর্শন, বাবার কাছে যেমন যেমন শুনেছিলাম গড় গড় করে বলতে শুরু করলাম—উনি আমায় মধ্যপথে থামিয়ে দিলেন। আমার কচি মুখে উচ্চ দর্শনশাস্ত্র কি রকম শোনাচ্ছিল এখন বুঝতে পারি। উনি বললেন, “থাক থাক, তুমি শুধু পড়–যখন সময় হবে, অর্থ আপনি বুঝতে পারবে। পাখি যে গান গায় তারও কোনো অর্থ আছে বিশ্ব ব্যাপারে, সে কিন্তু সেটা জানে না। তাতে ক্ষতি নেই, তেমনি মনের আনন্দে তুমি পড়, অন্যের ব্যাখ্যা তোমার কোনো কাজে লাগবে না।”
এ সময় একজন রুশ পণ্ডিত প্রায়ই আসতেন, তার নাম আমার মনে পড়ে না, হয়তো তিনিই বগদানভ—শান্তিনিকেতনে যেসব বিদেশী পণ্ডিতব্যক্তি আসতেন যাবার আসবার পথে তারা একবার আসতেনই আমাদের বাড়িতে। শাস্ত্র-আলোচনায় আমি সাহসের সঙ্গে যোগ দিতাম। তত্ত্বচিন্তার একটা আবহাওয়া, সেটা আমার মত অল্পবয়সীদের কাছে একটা কুয়াশা ছাড়া কিছু নয়—কিন্তু সেই প্রহেলিকাময় নীহারিকা আমার ভালো লাগত। সেই নীহারিকা ভেদ করে সূর্যের আলো অবশ্যই আমাকে উত্তপ্ত ও সজাগ করে রাখত। এক দিকে ব্যক্তিমানুষের জীবন্ত অনুভবের সত্য শিল্পের বেদনায় ঝঙ্কৃত, অন্য দিকে এক নিরন্তর অনন্ত জিজ্ঞাসার প্রহেলিকা আমার সেই উন্মুখ সতেজ নবীন মনের উপর আলোছায়ার খেলা করছিল। আমাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের পরিবারের থেকে আমাদের বাড়িটা ছিল স্বতন্ত্র—আর আমার সমবয়সীদের কাছে, বিশেষত স্কুলের সহপাঠীদের কাছে আমি ছিলাম দুর্বোধ্য। তারা আমায় ক্ষেপাতো আমি অন্যমনস্ক বলে। অন্যমনস্ক, অর্থাৎ যখন যেটাতে মন দেবার কথা সেটা ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতাম।
আমাদের সময়ে ছেলেমেয়েদের মেশামেশি কম ছিল তবু আমরা পর্দানশীন ছিলাম না। আমার মা, বাবার সহকর্মীদের সামনে সব সময় না বেরুলেও ছাত্রদের সামনে বেরুতেন—আমি তো সকলের সামনেই বেরুতাম। মফঃস্বলে থাকতে মাকে দেখেছি চিকের আড়ালে বসে বসবার ঘরের সাহিত্য-আলোচনা শুনতেন ও আড়াল থেকে জলখাবার পান শরবৎ পাঠিয়ে দিতেন। কলকাতায় এসে সে আড়াল উঠে গেল। আমরা সর্বত্র যেতাম। সাহিত্যসভায় কবিতা আবৃত্তি করতাম, যেখানে একটি মেয়ে নেই। এতটা তখনকার দিনে খুব কম মেয়েই করেছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও আমাদের মুখের উপর একটা অদৃশ্য ঘোমটা থাকত। আমরা সহজে কারুর সঙ্গে কথা বলতাম না। হয়তো বাবার কোনো ছাত্র তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাদের সঙ্গে এগিয়ে এল, আমি মাথা নীচু করে হাঁটতাম, তার সঙ্গে কথা বলতাম না। সত্য কথা বলতে কি আমরা পর্দাবিহীন পর্দানশীন ছিলাম। কথা বলতে ইচ্ছে করত না তা নয়, খুবই করত, আমি জানতাম অপর পক্ষেরও তাই। তবে কথা বলতে বাধা কি? কেউ তো আর আমাদের বারণ করেনি। কিন্তু আমরা পারতাম না। আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্য পুরুষ মানুষদের সামনে, বিশেষতঃ যুবকদের সামনে আমরা একেবারে পাথর হয়ে যেতাম। তারাও তাই। যেন কেউ কাউকে দেখতেই পাচ্ছি না। কত যুগযুগের সঞ্চিত নিষেধের প্রভাব আমাদের রক্তস্রোতে বইছে, একে পার হওয়া দুষ্কর, কিন্তু আজকের দিনে কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে এই নিষেধটা কেন, এর ভিতরের কারণটা কি সে সম্বন্ধে আমরা, অন্তত আমি বিশেষ কিছু জানতাম না। এই সব শিক্ষিত উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে যৌন ব্যাপার সম্বন্ধে কোনো আলোচনা হতো না। আভাসে ইঙ্গিতে, একটা ঢাকনা পরা লুকানো জগৎ আছে, সেটা অবশ্যই আমরা বুঝতাম কিন্তু সেখানকার ব্যাপারটা কি তা জানা ছিল না। আমাদের বেছে বেছে উপন্যাস পড়তে দেওয়া হতো। বিশেষ বিশেষ কতগুলি বিখ্যাত বই একেবারে নিষিদ্ধ, তার মধ্যে কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘চোখের বালি’ ও ‘চরিত্রহীন’। নৌকাডুবি’ পড়বার অনুমতি ছিল। নৌকাডুবি’র মলাটটা খুলে নিয়ে চোখের বালি’তে লাগিয়ে পড়ে ফেলেছিলাম। অবশ্য কেন বইটা এত নিষিদ্ধ তা বুঝতে পারিনি।