আমার মনে পড়ে না সেটা কোন মাস যে-দিন মির্চা ইউক্লিড প্রথম আমাদের বাড়ি এল, অর্থাৎ আমি প্রথম লক্ষ্য করলাম তাকে। আমার বাবা পণ্ডিত ব্যক্তি, মাত্র ছয় বছর আগে তিনি পূর্ববঙ্গের একটা মফঃস্বল কলেজে অধ্যাপনা করতেন, তারপর কলকাতায় এসেছেন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কলকাতা শহরে বিদ্বৎসমাজে সম্মানের উচ্চচূড়ায় পৌঁছে গেছেন। সবাই তাকে চেনে। তিনি পণ্ডিত এবং অসাধারণ পণ্ডিত। সেজন্য। অনেকেই তাকে ভয় করে, ঐ পাণ্ডিত্যের একটা আক্রমণকারী রূপ আছে। যে কোনো ব্যক্তিকে অল্প সময়ের মধ্যে বিতর্কে হারিয়ে তাকে মূর্থ প্রতিপন্ন করে দিতে পারেন এবং এ খেলায় তিনি বেশ আনন্দ পান। কিন্তু এ সত্ত্বেও তার আকর্ষণী শক্তি অদ্ভুত। তিনি যাদের অপমানিত করেন তারাও তাঁর কাছ থেকে পালায় না। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তার জন্য অনেক ত্যাগ করতে প্রস্তুত, তিনিও তাদের ভালোবাসেন কিন্তু সে ভালোবাসা আমাদের সাধারণ মানুষের ভালোবাসার মতো নয়। তাতে অপর পক্ষের প্রতি সমবেদনা নেই। ভালোবাসাটা তার নিজের জন্যই, যেমন আমাকে ভালোবাসেন, খুবই ভালোবাসেন, সেটা আমার জন্য যত না তত নিজের জন্য—এই দ্যাখো আমার কন্যাটি কী অমূল্য রত্ন, দেখতে কী সুন্দরী, কী চমৎকার কবিতা লেখে, কী সুন্দর ইংরেজী বলে—এ তো আমার মেয়ে, দ্যাখো দ্যাখো তোমরা! আমাকে নিয়ে মেতে আছেন বাবা। কিন্তু জানি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটু নড়লে আমাকে চূর্ণ করে দিতে তাঁর বাধবে না। আমি কিসে সুখী হব সেটা তার কাছে অবান্তর।
আমার মা একেবারে বিপরীত। আমার মা, পরমাসুন্দরী। ঐ সময়ে তার সৌন্দর্য অলৌকিক, স্বর্গীয়। তাতে বাবা খুব গর্বিত কিন্তু মার কোনো খেয়ালই নেই—মা কোনোদিন প্রসাধনে যত্ন করেন না, নিজের কোনো সুখস্বাচ্ছন্দ্য, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই বললেই হয়। বাবাকে সুখী করাই তার একমাত্র কাজ। সেই কাজে বাবা তাকে যথেষ্ট ব্যাপৃত রাখেন—বিশেষ করে সামান্য একটু অসুখ করলে হৈ চৈ করে এমন অবস্থা করে তোলেন যে মার মনে সর্বদা ভয় এই বুঝি তার স্বামীর ভয়ানক একটা কিছু হল। মা বৈষ্ণবসাহিত্য পড়তে ভালোবাসেন, দুটো লাইন তিনি প্রায়ই বলেন—
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে কহি কাম
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।
শুধু যে স্বামীকে প্রীত করবার ইচ্ছা তা নয়। চার পাশের প্রত্যেকটি লোকের জন্য মায়া-মমতার সুধাপাত্র মার হাতে ভরাই আছে।
সে সময়ে আমাদের বাড়িতে সর্বদা বিদেশীরা যাতায়াত করতেন। নানা বিষয়ে আলোচনা হতো, যারা আসতেন তাদের মধ্যে বিদূষী স্টেলা ক্ৰামরিশ ও অধ্যাপক তুচির কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, ফর্মিকিও বোধ হয় এসেছিলেন। অধ্যাপক তুচি পরে ভালো বাংলা শিখেছিলেন—তাকে দেখতে ছাত্রের মতো ছিল—কচি মুখের উপর অবাধ্য চুলগুলো কপালে এসে পড়ত বার বার। তার স্ত্রী বেশ চৌকো চৌকো চেহারা, গলায় মুক্তার মালা। তাঁদের আসা-যাওয়ার জন্য বাড়ির চেহারা ক্রমে বদলে যাচ্ছিল। বাঙ্গালীয়ানার উপর সাহেবিয়ানার ছোঁয়াচ লাগছিল। বছরখানেক আগে আমার ঠাকুমা মারা গিয়েছিলেন তাই এই উন্নতি সম্ভব হয়েছিল, নইলে হতো না। বেশ মনে আছে ১৯২৪ সালে প্রথম যেদিন খাবার ঘরে বিরাট মেহগনি টেবিল এল, ঠাকুমা অনেকক্ষণ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন, তার হাতের সোনার জপের মালা থেমে গিয়েছিল—“কী, এর উপর খাওয়া হবে কেন? শুলে কি দোষ হয়? এটা তো একটা খাট-ই!” তারপর যখন দেখলেন কোনো উপায়। নেই, কথা টিকবে না, তখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বৃহৎ কাষ্ঠে দোষ নেই। তিনি পারতপক্ষে ও-ঘরের কাছেও যেতেন না। আর যেদিন কাটাচামচ দেখলেন, সেদিনের কথা ভুলব না, ভূকুটি করে মাকে বললেন, ‘ভাত খাওয়ার জন্য অতগুলো যন্তর লাগবে।’ প্রতিশোধস্পৃহা এতদূর বেড়ে গিয়েছিল যে প্রায়ই আশা প্রকাশ করতেন যে ঐ কাটা দিয়ে ‘জেহ্বাটা’ এ-ফোঁড় ও-ফোড় হলে তবে শিক্ষা হয়! ঠাকুমার সংস্কারগুলো যে কত অনড় আর তার পক্ষে কত সত্য তা তিনি তার মৃত্যুশয্যায় দেখিয়ে গিয়েছেন। কলেরা রোগাক্রান্ত হয়ে তিনদিন ভুগে তিনি মারা যান। প্রথম দুদিন মা সমস্ত সেবাটা করলেন, কাকা তাকে সাহায্য করলেন। মা তখন গর্ভবতী ছিলেন—ডাক্তার খুব রাগ করতে লাগলেন, শেষপর্যন্ত বাবাকেও বকাবকি শুরু করলেন, অবশেষে মাকে সরে যেতে হলনার্স এল, ক্রিশ্চান নার্স। তাকে শিখিয়ে দেওয়া হল ঠাকুমা জাত জিজ্ঞাসা করলে বলবে ‘ব্রাহ্মণ’—।
রুগী অধচৈতন্য চোখ ঈষৎ উন্মীলিত করে বললেন, ‘জল’নার্স জল নিয়ে এগিয়ে এল—“এই যে জল খান, মুখ খুলুন”—মুমূর্ষ নারী মুখ খুললেন না, চোখ খুললেন, তার মৃত্যুআচ্ছন্ন কানে গলার স্বরটা অপরিচিত ঠেকেছে, “তুমি কে মা?”
“আমি নার্স।”
“আচ্ছা থাক একটু পরে জল খাব।” কলেরা রোগাক্রান্ত রুগীর মুহুর্মুহু তৃষ্ণা। তিনি আবার বললেন–“জল”…
“এই তো জল এনেছি খান”, ফিডিং কাপটা এগিয়ে ধরেছেন নার্স—
“আমার বৌমাকে ডেকে দাও”—
“তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আমার কাছেই জল খান না।”
“তুমি কি জাত?”
“ব্রাহ্মণ।”
“সধবা না বিধবা—”
“বিধবা”—এবারে মৃত্যুপথযাত্রিনী ভালো করে তাকালেন, ইনি সব –র কি রোগ, রোগের গতি কি, এখন কি অবস্থা কিছুই তাঁর অজ্ঞাত নয় কারণ তিনি কবিরাজ বাড়ির বধূ—চিকিৎসকদের সঙ্গেই জীবনের অনেক দিন কেটেছে। “দ্যাখো নার্স আমার পেট ফেঁপেছে, কলেরা রুগীর পেট ফাপলে আর বাচে না—”মুমূর্ষ রুগীর এখন টন্টনে জ্ঞান ফিরে এসেছে। কোমার ব্যাপারই ঐ, মাঝে মাঝে রুগী সজাগ হয়ে যায়। “ও নার্স তুমি খেয়েছ ত? কি দিয়ে ভাত খেলে?”