আমাকে গাড়িতে তুলে দিতে এসে সেরগেই আবার আমার করপল্লব চুম্বন করল আমার পায়ের তলা থেকে একটা তীব্র তীক্ষ্ণ অনুভূতি উঠে এল। আমি বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করে নিলাম। এটা গোলপার্ক—১৯৭২ সাল; ১৯৩০ সালে এ জায়গাটা জঙ্গল ভরা ছিল। আমি গাড়িতে উঠে দরজাটা শক্ত করে ধরে বলতে লাগলাম—“এটা একটা ট্যাকসি, শেভরলে নয়।”
আমাদের প্রথম গাড়িটা ছিল শেভরলে, হুড খোলা, উঁচু। এখনকার রুচিতে সুন্দর নয়, কিন্তু আমাদের তখন কি সুন্দরই লাগত। গাড়ি থেকে নামবার সময় মির্চা সব সময় হাত বাড়িয়ে দেবে।
“কেন এইটুকু নামতে সাহায্য লাগে নাকি?”
“আমাদের দেশের এই নিয়ম, মেয়েদের গাড়ি থেকে হাত ধরে নামাতে হয়। আর অভ্যর্থনা ও বিদায় অভিনন্দন জানাতে করপল্লব চুম্বন করতে হয়।”
“নিয়ম?”
“হ্যাঁ নিয়ম। না করলে লোকে তাকে বর্বর বলবে। তোমাদের এরকম কোনো নিয়ম নেই?”
“না। বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। সমবয়সীদের নমস্কার করা আছে। তা বড় একটা কেউ করে না। ঠাকুরবাড়ি থেকে এসব আদবকায়দা শুরু হয়েছে। শান্তিনিকেতনে রবিঠাকুর শেখাচ্ছেন ওখানকার ছাত্রছাত্রীদের। ওরা সবাইকে হাতজোড় করে নমস্কার করে। ছাত্ররা পরস্পরকে নমস্কার করে। দেশের অন্যত্র সবাই এতে হাসে!”
“ঐ একজন লোকই কি তোমাদের সব কিছু করবেন?”
“হ্যাঁ তাই, তাঁ তাই, ঐ একজন লোকই আমাদের আকাশ জুড়ে আছেন, আমাদের মুখে কথা দিচ্ছেন, আমাদের মনে ভালোবাসা দিচ্ছেন, সে আছে বলে আমার আকাশ জুড়ে ফোটে তারা রাতে, প্রাতে ফুল ফুটে রয় বনে।”
মির্চা স্তম্ভিতবিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে আছে-“এ আবার কি, একজন মানুষ সম্বন্ধে এরকম করে বলছ! আমি তোমায় বুঝতে পারি না।”
“বয়ে গেল?”
বাড়ি এসে পৌঁছেছি। আমার পুত্রবধূ লেখা আমায় বললে, “হঠাৎ কোথায় চলে গেলেন? আজ‘খ’ বাবুর আসবার কথা ছিল না? কাজের জন্য একজন লোক নিয়ে?”
এই কন্যাটিকে আমি ভয় করি। প্রখর বুদ্ধিমতী মেয়ে আর সর্বদা আমার কাছে থাকে, কী যে বুঝে নেবে কে জানে! আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে।…আমি খুব হাসি হাসি মুখে খবাবুর বক্তব্যগুলো শুনলাম। কিন্তু কোনো কথা আমার কানে ঢুকছে না—আমার চোখে জল আসছে, বুকের ভিতরটা কাপছে। এরকম হলে তো চলবে না। এ আবার কি এতদিন পরে? আমি হাসছি, একটু অসঙ্গত রকমই হাসছি। বিকালে আমার জন্মোৎসব সে সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করছি কিন্তু আমার কোনো কৌতূহল নেই, কিছু জানতে চাই না। আমি বুঝতে পারছি না এত অল্প সময়ে জগৎটা বদলে গেল কি করে! এত কষ্ট কেন?…আমার বন্ধুরা আমার জন্মোৎসব করবে এতে আমার গর্ব নেই—ওরা আমাকে আদর করে কি করবে? আমায় কি শান্তি দিতে পারবে? আমি বুঝতে পারছি সেরগেই এসে আমার শান্ত স্রোতহীন স্থির জীবনের মাঝখানে একটি লোষ্ট্রপাত করে যে তরঙ্গবলয় সৃষ্টি করেছে এ আমাকে সহজে ছাড়বে না, থামবে না এর আবর্ত। শান্তির আশা এখন বহুদূর। আমি চোখ বুজে চেয়ারে পড়ে আছি। কি চাই আমি? কিছু না, কর্ম, সমাজসেবা, দেশের উন্নতি জাহান্নামে যাক্, কিছু চাই না—নিয়ে চল সেই ১৯৩০ সালে আর একবার ওকে দেখব। মির্চা, মির্চা, মির্চা!
হঠাৎ মুখ তুলে দেখি, লেখা আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে—“মা আপনার কি চোখে আবার কষ্ট হচ্ছে? জল ভরে আছে কেন? ওষুধ দেব?”
“হ্যাঁ দাও।”
জন্মদিনের বিপজ্জনক সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। নিজের কৃতিত্বে আমি খুশি। আমি নুতন শাড়ি পরেছি, ফুলের মালা পরেছি, কবিতা আবৃত্তি করেছি, গান শুনেছি, কেউ কিন্তু বুঝতে পারে নি আমার ভিতরটা সর্বক্ষণ কিরকম থরথর করে কাপছে! এ কথাটা উপমা দিয়ে বলা নয়—সেই কম্পন যদি শরীরে দেখা যেত লোকে মনে করত আমার পারকিনসন্স রোগ হয়েছে।
রাত্রি দুটোয় বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি—এখন ভোর হয়ে এল। তারাগুলো একদিক থেকে অন্যদিকে চলে গেছে। এ বাড়িতে ছাতে ওঠা যায় না, এই এক বিপদ। ভালো করে আকাশ দেখতে পাই না। আমি চিরদিন আকাশের নিচে শুয়ে থাকতে ভালোবাসি। মির্চাও ছাতে বেড়াতে খুব ভালোবাসত। প্রথম দিন ছাত দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
“জানো আমাদের দেশে ছাতে ওঠা যায় না?”
“সে আবার কি! তোমরা সূর্য তারা দেখ কি করে!”
“সূর্য তারা দেখে অ্যানমাররা, সাধারণ লোকে সে কথা ভাবেই না।”
“আমাদের দেশে লোকে সকালে প্রথমেই সূর্য প্রণাম করে।”
“তুমি কর?”
“আমার সূর্য ভিতরেও আছে বাইরেও আছে। আমি সব সময়ই প্রণত। সকাল-বিকাল নেই।”
“তার মানে? বলল, বলল, হাসছ কেন, বলতেই হবে।”
“না বলব না। তুমি বুঝবে না।”
“তুমি আমায় অপমান করছ—বুঝতেই পারব না?”
“বলতেই হবে ভিতরের সূর্য কে।”
“আমার গুরু। তিনিই আমায় এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখাচ্ছেন।”
“তিনি কি শুধু নিজেকেই দেখান, না আরো কিছু দেখান?”
“সমস্তই দেখি তারই আলোকে।”
“যেমন?”
“যেমন এই তোমাকে দেখছি।”
ও সেদিন খুশি হয়েছিল–“আজ সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে হুইটম্যান পড়বে?”
“দুর অত নীরস লেখা বুঝতেই পারি না। তার চেয়ে শেলী পড়ব—সেসেটিভ প্ল্যান্ট।”
যাই গিয়ে শুয়ে পড়ি। কাল কত কাজ আছে—বিকালে মিটিং আছে। বিয়াল্লিশ বছর আগেকার কথা মনে করে লাভ কি! কোথায় বা সে মির্চা, আর সে কোন অমৃতা, দেখলে হয়তো চিনতেই পারব না কেউ কাউকে!
দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই আমার বর্তমানে স্থির থাকতে পারছি না। বারে বারে কখনো দিনে কখনো রাতে আমি ফিরে ফিরে চলে যাচ্ছি ভবানীপুরের বাড়িতে, ১৯৩০ সালে।