“ও লোকটা ওরকম করছিল কেন?”
“ঠাট্টা করছিল। রোজ রোজ পর্দা বদলানো দেখে ও বলে আমার যখন সংসার হবে সেখানে প্রত্যেক দরজায় এতগুলো করে পর্দা ঝুলবে যে একটা সরালেই আর একটা, সেটা সরালেই আর একটা, এমনি করে করে ক্লান্ত হয়ে যাবে মানুষ, কেউ আর ঘরে ঢুকতেই পারবে না। কি রকম অবস্থাটা হবে তাই ও ভঙ্গী করে দেখাচ্ছিল। এতে হাসি পায় না? মুখ ভার কর কেন?”
“এর কি কোনো ভিতরের অর্থ আছে?”
“দেখো একবার, এর আবার ভিতরের অর্থ কি? শুধু মজা করা।” মির্চার এই স্বভাব, সব কিছুর ভিতরে অর্থ খোঁজে!
“তোমার ওকে কি এত ভালো লাগে! বাফুন, জোকার, সঙ”—আহা, কি অদৃষ্ট! আজ মির্চাকে সেই খোকার সাহায্য নিতে হচ্ছে। এখন ওই ওর একমাত্র বন্ধু। ও ছাড়া আর কেউ তাকে আমার খবর দেবে না। আমাকেই বা কে দেবে
“খোকা, ভাই থোকা”–
“রু, তাড়াতাড়ি লেখ ভাই, আমাকে এখানে দেখতে পেলে মামা ভীষণ রাগ করবেন। হয়তো আজই এখান থেকে তাড়িয়ে দেবেন।”
আমি লেখবার চেষ্টা করছি—কি লিখব ভেবে পাচ্ছি না—মির্চা আমার বইটা চেয়েছে। খোকা বলেছে ওর কাছে তোমার একটা বই নেই, বইটা দাও, তাই আমি বইটাতেই লিখছি, কি লিখব ভয়ে কাপছে আমার ভিতরটা। মির্চা যদি সব সত্যি কথা বলে দেয়? ও জানে আমি সহজে মিথ্যা বলি না। ওকেও তো জানি মিথ্যা বলে না। কিন্তু আমি মিথ্যা বলেছি, ওকে বাচাবার জন্যই বলেছি। এখন বুঝতে পারছি মিথ্যা সব সময়ই খারাপ নয়। কি আশ্চর্য, এমন একটা কথা কি করে আমার মনে এল? মা তাই বুঝি বলেন, একটা অন্যায় আর একটাকে ডেকে আনে—মিথ্যার পিছনে মিথ্যা দৌড়ায়, সত্য আর তার নাগালই পায় না! ছি ছি, আমিও এত খারাপ হলাম। আমার গুরু কি বলবেন? আমি যে সূর্যের আলোতে মুখ তুলে আছি। আমি যে ভেবেছিলাম, শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ থাকব। হল না, হল না। আমি দেখতে পাচ্ছি বইয়ের পিছনের পাতা খুলে আমি লিখছি—আমার হাত কাপছে। অক্ষরগুলো কাপছে। লাইন বেঁকে গেল। যেন কোনো অন্ধকারের ভিতর থেকে আমার ষােল বছরের শরীরটা ফুটে উঠেছে। আমার চুল অবিন্যস্ত, তিন দিন আমি আঁচড়াই নি, এই তিন দিন শরবৎ ছাড়া আমি কিছু খাই নি। খার না। আমি মনে মনে বলছি, কোনো দিন খাব না, চুল কেটে ফেলব, পাড় ছিড়ে ফেলব তবে মার শিক্ষা হবে। দিদিমা এসে যখন জিজ্ঞাসা করবেন, ওর কি হয়েছে? তখন তো মাকে বলতেই হবে। দিদিমা কি বলবেন? আমি জানি জানি জানি, তিনি মনে মনে বলবেন, এই মেয়ে স্বয়ংবরা হয়েছে, তার আর অন্য পতি হয় না। কিন্তু মুখে একটি কথাও বলতে পারবেন না। বাবার ভয়ে। একজন মানুষকে এত লোক ভয় করে।…মির্চাকে লিখলাম, সাবধান করে দিলাম। এর বেশি যেন না স্বীকার করে। বুঝবে তো? কী জানি। এর বেশি তো আমি লিখতে পারছি না, ইংরেজি কথাই আমার মনে পড়ছে না।
সেরগেই বললে, “মির্চা কিন্তু তোমার চেয়ে অনেক বুড়ো হয়ে গেছে।”
আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি, আমার চোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছে—সেরগেই বুঝতেও পারে নি, এতক্ষণ আমি এখানে ছিলাম না। আমি কি দেখছিলাম? কোথায় থোকা? সে তো এখন বৃদ্ধ জীর্ণ একটা মানুষ কালীঘাটে না কোথায় থাকে, কত বছর তার খবরই রাখি না। এখানে সেই পাথরের বারান্দা কি ভ্রাম্যমান কার্পেটে ভেসে এসে পৌছেছিল? কী আশ্চর্য! কী বিস্ময়! এর ঘোর কাটতে চায় না। সেই গানটা মনে পড়ছে ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহিরে’-আলো ছাড়া দেখা যায় তাহলে? আলোর তরঙ্গ ছাড়া আরো কোনো তরঙ্গ আছে? আছে, নিশ্চয় আছে। আমার অলৌকিকে বিশ্বাস হচ্ছে যদিও আমি নাস্তিক কারণ এতক্ষণ বা একটি ক্ষণে একটি মুহূর্তে কিম্বা সময়ের অতীত কিছুতে যা ঘটল তা স্মৃতি নয়, মনে পড়া নয়, তা বাস্তব অনুভূতি। আমি ১৯৩০ সালের ২০শে সেপ্টেম্বরের সকালে উপস্থিত হয়েছিলাম আমার হাতের নিচে পাথরের ঠাণ্ডা লেগেছিল, অবিশ্রাম কান্নায় আমার চোখ ভারি ছিল, তিনদিনের অনাহারে আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, forehead. লিখতে গিয়ে একটু ইতস্তত করেছিলাম বানান নিয়ে, আমার সন্দেহ হচ্ছিল ‘e’ টা লাগবে কিনা। অতীতকালের এই প্রত্যক্ষ অনুভূতিকে রূপ দেবার ভাষা আমার নেই। ১৯৭২ সাল ১৯৩০ সালে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল। আমি সেরগেই-র সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছি কিন্তু আমার ভিতরটা কাপছে। ঝড়ের মুখে একটা ছোট্ট বিপন্ন পাতার মতো কাপছে। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এই এখানে আছি, এখুনি এখানে নাও থাকতে পারি। আমার মনে হচ্ছে আবার এমনি হবে—আবার আমি কালের মধ্যে পিছনে ফিরে যাব। কি করে সম্ভব হচ্ছে এটা? যদিও আমি বুঝতে পারি কালের কোনো উদয় অস্ত নেই, উদয় অস্ত আমারই—কিন্তু আমার এই পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে যে খণ্ডিত জগৎটাকে আমি চিনি, জানি, তার বাইরে পা দিতে আমার সাহস কোথায়? সেই অজ্ঞাত জগতে পা দিতে আমি ভয় পাই। আজকের যে অভিজ্ঞতাটা হল এটা ভয়ানক, এটা কষ্টকর, বিপর্যয়কারী। আমার সমস্ত ধারণা, আত্মবিশ্বাস গোলমাল করে দিচ্ছে। কে আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করবে? আমি সেই ১৯৩০ সালের মতোই আবার আমার গুরুকে ডাকতে লাগলাম,—প্রভু আমায় পরিত্যাগ করো না।’ ‘নাথ হে ফিরে এস—আমার সব সুখদুখমন্থন ধন অন্তরে ফিরে এস’–আমি আর কিছু চাই না, কাউকে চাই না, আমার জীবনে আর কিছু নেই, আর কিছু ছিল না, আমার সমস্ত অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ জুড়ে তোমার গানে গানে এক জ্যোতিবিকীর্ণ মহোৎসব—আমার কোনো অভাব নেই দৈন্য নেই। আজ কি হঠাৎ কোথাকার অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তি দুটো কথা বলে সব চুরমার করে দেবে! এতদিন পরে কি ধ্রুবতারকার জ্যোতি নিভে যাবে? আমি পথভ্রষ্ট হব?