আমি চমকে উঠেছি। বুকের ভিতর দপ্ করে একটা স্মৃতির দীপ জ্বলে উঠল। ঠিক, ঠিক, ঠিকই।—“আরো বলো সেরগেই, এমন কি কিছু আছে যাতে আমি লজ্জা পাব?”
সেরগেই মাথা নিচু করে বললে, “সে লিখেছে রাত্রে তুমি তার ঘরে আসতে। অবশ্য আমি তো এতে লজ্জার কিছু দেখছি না।”
আমি তো স্তম্ভিত—“কী সর্বনাশ! কী অন্যায়! বিশ্বাস কর সেরগেই, এ সত্য নয়, একেবারে সত্য নয়।”
ও আমাকে সাহস দিচ্ছে, তা বোঝা যায়, তাই ত তোমায় বর্ণনা করতে পারে নি, লিখেছে তুমি অন্ধকারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ-ওর তো উপায় ছিল না, ওর যে তখন বড় কষ্ট।”
আমি অসহায় বোধ করছি, যেন জলে পড়েছি। অপ্রিয় সত্যকে গ্রহণ করবার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে পারি কিন্তু অপ্রিয় মিথ্যার আঘাত তো অসহনীয়।
অ্যাশ-ট্রেতে সিগারেটটি নির্বাপিত করে এই ভালোমানুষ বিদেশী ব্যক্তিটি বললে, “ক্ষমা কর, আমি তোমায় সবটা বললাম, সত্য কথাই বলতে হল।”
“বলতে পার সেরগেই, কেন সে আমার নাম করে বইটা লিখেছে?”
“তোমার নামের বন্ধন সে এড়াতে পারে নি, তখন যে তার কষ্ট, বড় কষ্ট—তুমি বইটা পড়লে চোখের জলে ভাসবে।”
“তাই বলে এমন একটা মিথ্যা কলঙ্ক দেবে?”
“ওটা তার কল্পনা, তখন তার যন্ত্রণার হাত থেকে উদ্ধারের ঐ একটাই পথ ছিল। তোমাকে তো এখনও ভোলে নি।” আমার দিশাহারা লাগছে, কি বলব আমি—“আশ্চর্য যুক্তি তোমার সেরগেই, যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া! আর এতই যদি তার ভালোবাসা ছিল তবে আমার বাবার একটি ধমক খেয়েই আমাকে ফেলে চলে গেল কেন? এমন কখনো হয়? শুনেছ কখনো?”
“হয় না? শুনি নি? এরকম দৃষ্টান্ততেই তো ইতিহাস ভরা। তুমি তখন ষােল বছরের একটি মেয়ে ছিলে, সে তেইশ বছরের তরুণ—আহা তোমার বাবা তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিলেন।”
আমার শরীর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হল। এ মানুষটা বলে কি! “সেরগেই, তুমি আমার জীবনের কি জাননা! আমার জীবন নষ্ট করে সাধ্য কার! আমার সমৃদ্ধ জীবন। ছেলেমেয়ে নাতিনাতনী নিয়ে আমার আদর্শ সংসার। কত মানুষের ভাললাবাসা পেয়েছি, সম্মান পেয়েছি। সর্বোপরি আমার গুরু, যার সম্বন্ধে তোমার বন্ধুর অত ঈর্ষা, তাঁর আশ্চর্য স্নেহে অভিষিক্ত আমার মন এমন অতীন্দ্রিয় ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছে যা বাক্য বা মনের অতীত বস্তু। ঐ একটা তেইশ বছরের ছেলের জন্য আমার এই আটান্ন বছরের জীবনে কোনো স্থান আছে কি?”
আমি খুব উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলছি, আমার মাথার মধ্যে শিরা উপশিরা দপদপ করছে, আর ভয়ও হচ্ছে, আমার যে বয়স অনেক, স্ট্রোক হয়ে যাবে না তো!
সেরগেই বিপন্ন মুখে অপ্রস্তুত হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। “নানা, জীবন নষ্ট নয়-জীবন অন্যরকম হতো।” “তা বলতে পার। অন্য রকম, এই মাত্র!”
“তোমার প্রথম কবিতার বইখানা আমার কাছে আছে। ওকে যখন দেশ ছেড়ে যেতে হল তখন ওর সমগ্র লাইব্রেরী আমি নিয়ে এসেছিলাম, তার মধ্যে তোমার বইখানাও ছিল?”
“বল তো কি রকম দেখতে?”
“নীল কাপড়ের শক্ত মলাটে বাধান, বড় একটা সোনালী রং-এর ফুলের নকশা মাঝখানে?”
আমি হাসছি। “কি আশ্চর্য, ঠিক তো। সে যে কতকাল আগের কথা! কি করে জানলে ওটা আমার লেখা বই?”
“শেষের পৃষ্ঠায় তেরছা ভাবে একপাতা থেকে আর এক পাতায় চলে গেছে তোমার হাতের লেখা, তুমি লিখেছ—Mircea Mircea Mircealhave told my mother that you have only kissed me on my forehead—”
সেরগেইর মুখের কথাটা শেষ হয়নি—আমার পায়ের তলা শির শির করে উঠল। আমি একটা নিচু চৌকিতে বসে মাটিতে পা ছুঁয়েছিলাম—আমার মনে হল আমার পা আর মাটিতে নেই—এ ঘরের ছাত নেই। আমি শূন্যে মহাশূন্যে চলেছি—অথচ আমি জানি আমি সেরগেইর দিকে তাকিয়ে আছি, সে মৃদু মৃদু হাসছে, আমিও হাসছি কিন্তু কী আশ্চর্য সেই শারীরিক অনুভূতি—আমি দ্বিধাবিভক্ত! আমি এখানে, অথচ এখানে নেই। আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছি ভবানীপুরের বাড়ির দোতালার বারান্দায় বারান্দার মেঝেটা সাদা কালো চৌকো চৌকো পাথরে বাধানো, যেন সতরঞ্চ খেলার ছক, মসৃণ পাথরের মেঝের উপরে আমি উপুড় হয়ে আছি। আমার হাতে ঐ বইটা। ঐ তো আমি, ঐ তো আমি–আমি আমাকে দেখতে পাচ্ছি, আমার বুকের মধ্যে হঠাৎ জলপ্রপাতের শব্দে সেদিনের কান্না ফিরে এসেছে—কি আশ্চর্য, আমি কিন্তু সেরগেইর সঙ্গে কিছু একটা কথা বলছি। সে তার পরিষ্কার উত্তর দিচ্ছে। আমার হাত চেয়ারের হাতলে কিন্তু আমি সেই পাথরের মেঝের মসৃণ স্পর্শ পাচ্ছি—আমার সামনে খোকা দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার নোংরা নখওলা পায়ের আঙুলগুলো দেখতে পাচ্ছি—ময়লা ধূতির একটা অংশ মাটি ছুঁয়ে আছে। এটা তো একটা সকাল! বোধ হয় ২০শে সেপ্টেম্বরের সকাল। ১৮ই সেপ্টেম্বর মির্চা চলে গেছে। খোকা আমায় বলছে, আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি—“রু তাড়াতাড়ি লিখে দাও ভাই”—তারপর একটা মুখভঙ্গী করে ফিস্ ফিস করে বলছে, “চারদিকে স্পাই ঘুরছে” এটা ও ঠাট্টা করে বলছে, ও খুব মজা করতে পারে, হাসাতে পারে।
খোকা আমাদের কেউ নয়। কিন্তু ভাইয়ের মতো। ওরা বড় দরিদ্র, ওর মাকে আমার ঠাকুমা মানুষ করেছেন। তারপর তার বিয়ে দেন। খোকার মাকে তাই আমরা পিসিমা বলি। পিসিমার আঠারটি সম্ভান, তাই ওদের দারিদ্র্য কোনোদিন গেল না। খোকা আর তার বোন শান্তি আমাদের আশ্রিত। যদিও তাদের সঙ্গে আমাদের খুব ভাব, আমরা বন্ধু, খেলার সঙ্গী—তবু ওদের মর্যাদা নেই—আশ্রিতদের যেমন কপাল, দাক্ষিণ্য পেলেও মর্যাদা পায় না। এমন কি মির্চাও ওর উপর সন্তুষ্ট নয়। সেটা অবশ্য অন্য কারণে কারণ থোকা আমাকে হাসায়। ও সামান্য বিষয়কে এমন করে বলে, এমন মুখভঙ্গী করে যে হাসতে হাসতে আমরা হয়রান হয়ে যাই। মির্চা অর্ধেক কথা বুঝতে পারে না তাই গম্ভীর হয়ে যায়। একদিন লাইব্রেরী ঘরে একটা নতুন পর্দা টাঙ্গিয়েছি, নানা রকম পর্দা দিয়ে ঘর সাজানো আমার একটা শখ। খোকা লাইব্রেরীতে পর্দা সরিয়ে ঢুকছে, এমন একটা ভঙ্গী করে যেন পাথর সরাচ্ছে, যেন ঢুকতেই পারছে না! ওর ভাবভঙ্গী দেখে আমি যত হেসে গড়াই দেখি মির্চার মুখ ততই ভার হয়ে যায়।