“হ্যাঁ, একটু একটু—কেন?”
“ওদের দেশ থেকে একজন ভদ্রলোক এসেছেন, তার পরিচিত, ইউক্লিড তোমার বাবার ছাত্র, তা তিনি তো আর নেই, তাই তোমার সঙ্গেই এ ভদ্রলোক দেখা করতে চান।”
একটা ছোট্ট আনন্দের বিদ্যুৎ আমার শরীর মনের ভিতর এক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে গেল।
গোপাল টেলিফোনের ওপার থেকে তাড়া দিচ্ছে—“চুপ করে কেন? ওকে নিয়ে আসব?”
“না আমিই যাব, ওর ঠিকানাটা দাও।”
সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল। কোনোমতে একটা ট্যাকসি জোগাড় করে গন্তব্যস্থলে উপস্থিত হলাম। ভাবছি কেন বা এলাম! যে চিঠি লিখলে উত্তর দেয় না, তার খবর জেনে আমার কি হবে? কিন্তু কৌতূহল ছাড়তে চায় না। আমি ভাবছি আমি কৌতূহলী, পরিচিত একজনের খবর জানতে চাওয়া খুব কি অন্যায়?
সত্যভাষণের খাতিরে বলতেই হবে সাধারণ মেয়ের মতো আমি একটু সেজেও নিয়েছি, একটা ভালো কাপড় পরেছি। তবু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে, চেহারাটা বড়ই খারাপ হয়ে গেছে। মহাকালের দাপটে কিছুই থাকে না—সব ভেঙ্গে চুরে জীর্ণ করে দেবে—কিন্তু তাই কি? কাল কি শুধু পুরানোই করে, নূতন করে না? চেহারাটা আমার পুরানো হয়ে গেছে বটে, কিন্তু মন? যে-মন আজ মির্চা ইউক্লিডের কথা জানতে চাইছে—সেই কৌতূহলী উৎসুকী মন নূতন, এও কালের সৃষ্টি। একদিন লিখেছি
“যে কাল পিছনে ছিল
সে কাল সমুখে ফিরে আসে—
অনবগুণ্ঠিত মুখে তারকাখচিত পট্টবাসে—
কে তারে ভূষণ দিল, দিল অলঙ্কার
ক্ষণস্থায়ী ঐশ্বর্যের বসন্তবাহার?
স্পর্শহীন স্রোতে তার রূপহীন আবেগে অতুল
কে ফোটাল ফুল?
শূন্যের সমুদ্র হতে নিমেষে নিমেষে ধরে কায়া
বেলাহীন বেলাতটে তরঙ্গের মৃত্যুময়ী মায়া।”
যখন লিখেছিলাম তখন জানতাম না পিছন কি করে সামনে আসে—পুরানো নূতন হয়, বা নূতন পুরানো বলে ভাবাটাই একটা ভ্রম মাত্র!
গাড়িতে বসে আমি হাসছি—আমার বেশ মজা লাগছে, কাণ্ডটা দেখ, আমার সাজবার দরকার কি ছিল? চেহারা নিয়েই বা আক্ষেপের কারণ কি? মির্চা ইউক্লিডের সঙ্গে তো আর আমার দেখা হচ্ছে না, দেখা হবে তার দেশের একজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে!
দরজাটা খোলাই ছিল। লোকটি টেবিলের উপর ঝুঁকে লিখছিল। তার রঙ তামাটে, ইয়োরোপীয়দের মতো সাদা নয়, শরীর নাতিদীর্ঘ, মুখে বুদ্ধির ছাপ। আমার সাড়া পেয়ে সে উঠে দাঁড়াল, বললে, “আমি সেরগেই সেবাস্টিন।” তারপর হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার ডান হাতখানি ধরে তার পল্লবের উপর চুম্বন করলে, এ ওদের দেশের রীতি। এই অতি পরিচিত ভঙ্গী যেন বহুবিস্মৃত যুগের পদশব্দের মতো মনে হল।
“তুমি অমৃতা?”
আমি জানি এই বিদেশী ব্যক্তিটি যার কথা বলছে, আমার দিকে তাকিয়ে যাকে সে দেখছে, সে আজকের ১৯৭২ সালের অমৃতা নয়। যে বিস্ময় তার ঐ ক্ষুদ্র প্রশ্নে ধ্বনিত, সে আজকের অমৃতাকে দেখে জাগবে না। আজ তার মুখে বলিরেখা, চুলে সাদা রঙ, দেহ সৌষ্ঠবহীন, ও দেখছে স্থির দৃষ্টিতে, আমাকে পার হয়ে সে দেখা চলে গেছে বহুদূর, ও দেখছে ১৯৩০ সালের অমৃতাকে।।
“তুমি আমাকে চেন?”
“তোমাকে আমাদের দেশে সবাই চেনে, তুমি আমাদের দেশে রূপকথার নায়িকা।”
“কেন মির্চার বই?”
“হ্যাঁ, ওর বই। সে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, তোমার বাবা দিলেন না, তোমরা হিন্দু-সে ক্রিশ্চান।”
“বাজে কথা।”
“কি বাজে কথা?”
“হিন্দু-ক্রিশ্চান ওসব কিছু নয়। তার দম্ভ।”
“আজ বেয়াল্লিশ বছর হয়ে গেল মাঝে মাঝে শুনেছি ঐ বইয়ের কথা কিন্তু কখনো কাউকে জিজ্ঞাসা করিনি ঐ বইটি কি—উপন্যাস, কবিতা না প্রবন্ধ—আজকে বলো তো বন্ধু—ঐ বইতে কি আছে?” প্রশ্নটা করে আমি হাসছি। এইতো কত সহজে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম, এতোদিন করি নি কেন? ওতো আর এক অমৃতা। চল্লিশ বছর আগেকার মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কি? তার কর্মফল আমাকে কি আর স্পর্শ করে? বারো বছর পরেই তো আর খুনের অপরাধে দণ্ড হয় না। আমার লজ্জাই বা কেন? লজ্জা এইজন্য যে, আমি মরালিস্ট। ন্যায়-অন্যায় উচিত-অনুচিত নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, আমি কঠিনভাবে বিচার করি। দুর্বলতার প্রশ্রয় দিই না। আমার বন্ধুরাও আমার সামনে তাদের দুর্বলতার গল্প বলে না। আমি সম্মানের উচ্চাসনে বসে আছি, নিজেকেও তো কোনোদিন রেহাই দিই নি। যখনই মির্চার কথা মনে হয়েছে তখনই ভূকুটি করেছি নিজেকে। কেন এমন একটা ঘটনা ঘটল, না ঘটলেই তো ভালো ছিল—তখনই লজ্জা, বিষম লজ্জা আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছে, ওর স্মৃতিকে অবচেতনের গভীরে নির্বাসন দিয়েছি। কিন্তু আজ কত সহজে একে জিজ্ঞাসা করলুম ঐ বইটার কথা। মনে কোনো সংকোচ নেই।
সেরগেই বললে, “ও বই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস—”লোকটি ভালো ইংরেজি বলতে পারে না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে থেমে থেমে বলতে লাগল গল্পটা।
“জানো, ঐ বইতে ভারতবর্ষকে জেনে, কলকাতাকে জেনে, আমাদের দেশের লোক অবাক হয়ে গিয়েছিল।” ওর গলা শুনছি আর পরিচিত নামগুলি মনে পড়ছে, বুকে একটু একটু করে ধাক্কা লাগছে। যেন একটা একটা করে খড়খড়ি খুলছে—ঘরের ভিতর অন্ধকার, কিন্তু জানি ওখানে কি আছে। ওখানে ঢুকতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ভয়ে আমার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে।
“সেরগেই, সত্য বলো ঐ বইতে আমার কথা কি আছে?”
ও মৃদু মৃদু হাসছে, তারপর ওর কন্টিনেন্টাল উচ্চারণে ‘ত’-এর আধিক্য দিয়ে ও বলল, “ফাস্ত শী লাভদ্ এ ত্রি–first she loved a tree.”