“ভাই রু, সাবান মাখা ছেড়ে ভালোই হয়েছে-মশুরীর ডাল বাটা মেখে রঙ অনেক ফর্সা হয়েছে তোর।”
“যা যা বাজে কথা বলিস না। তোরা আমার রঙ আর চেহারা নিয়ে কিছু বলবি না। ভীষণ ভুল ধারণা হয়ে যায় আমার। তাতে ক্ষতি হয়।”
“তাই নাকি? আচ্ছা শোন্ পাউডার না হয় নাই মাখলাম—ঠোঁটে একটু আলতা লাগালে মন্দ হতো না।”
“ওরে বাবা, সাহস নেই বন্ধু, সাহস নেই।”
আমি সিঁথিটা পরছি ঠিক করে, আর মেঘদূত আওড়াচ্ছি—
“ভাই মীলু, একটা পদ্ম পেলে সাজটা পুরোপুরি হত।”
“কেন, পদ্ম কি করবি?”
“আরে যে সে পদ্ম নয়, লীলাকমল।”
মীলু মেঘদূত জানে না। “শোন বলছি—
হস্তে লীলাকমলমলকে বালকুন্দানুবিদ্ধং
নীতা লোর্ধপ্রসবরজসা পাণ্ডুমাননে শ্রীঃ
চূড়াপাশে নবকুরুবকং কর্ণে চারু শিরীষং
সীমন্তে চ ত্বদুপগমজং যত্র নীপং বধূনামা্–”
“আচ্ছা কুরুবক কি ফুল রে?”
“বক ফুল বোধ হয়।”
“দুর দুর, তা কখনো হয়। বক ফুল ভেজে খায়, তা নিয়ে কখনো কবিতা হয়?”
“কেন ভেজে খেলে তা নিয়ে কবিতা হবে না কেন?”
“শরৎচন্দ্র ও রবিঠাকুরের বিতর্কটা পড়ো না কেন? যা প্রয়োজনের বস্তু তা নিয়ে কবিতা হবে না।”
“তাই নাকি? সব ফুলই প্রয়োজনে লাগে।”
“যেমন?”
“ফল ধরাবার প্রয়োজন বন্ধু—ফল ধরাবার প্রয়োজন। এই যে তুমি ফুলের মতো…”
‘অ’ ঘরে ঢুকলো–‘অ’ আমার মা’র সম্পর্কিত ভাই কিন্তু বয়সে আমাদেরই কাছাকাছি, তাই আমাদের সঙ্গেও ভাইয়ের মতন সম্পর্ক। ওকে আমরা খুব ভালোবাসি-খুব মিষ্টি স্বভাব, মনোহরণ বাঁশি বাজায়। বাশিটি দোলাতে দোলাতে ঘরে ঢুকে আমাদের সাজ দেখে তার চক্ষুস্থির।
“ব্যাপার কি, চলেছ কোথায়?”
“কেন, বাড়িতে কি একটু সুন্দর হয়ে থাকা যায় না?”
“যায় বৈকি। এখন বলো, সুন্দরের স্থান কোথায়?”
ও আমার প্রবন্ধটার কথা বলছে। তারপর ঘুরে ঘুরে আমায় দেখছে—“এ্যাঃ, সিঁথি পরা হয়েছে।”
মোতিম হারে বেশ বনাদে, সিঁথি লগাদে ভালে—
উরহি বিলম্বিত লোল চিকুর মম বাঁধহ চম্পক মালে।
গানটা করতে করতে ‘অ’ আমার খোঁপা ধরে টান দিল, “খুলে ফেল খোঁপা—” আর সমস্ত কাধ বুক ঢেকে ‘লোল চিকুর মম’ ছড়িয়ে পড়ল। সেই মুহূর্তে আমরা তিন জনে আয়নার মধ্যে দেখলাম—চমৎকৃত তাকিয়ে আছি আমরা–। সন্দেহ নেই, জ্যেষ্ঠতাত ভয় দেখিয়েছে আমায়।
একটার পর একটা ঘটনার মধ্যে আমি আবার কি করে প্রবেশ করছি-কি করে এই কাহিনী লিখতে পারছি–তেতাল্লিশ বছর আগের কথা। দশ বছর আগে কি পারতাম? পনের বছর আগে? কুড়ি বছর আগে? কখনই না, তা হলে তো আমার জীবনই বদলে যেত। এতদিন আমি জানতামই না যে একটা বিয়োগান্ত উপন্যাস আমার সারা জীবনের মধ্যে ধীরে ধীরে অদৃশ্য কালিতে, অব্যক্ত ভাষায়, অশ্রুত স্পন্দনে লেখা হচ্ছিল। জীবনের বেয়াল্লিশটা বছর কেটে গেল, এ দৃশ্যগুলো বন্ধ ছিল। একেবারে গালামোহর লাগিয়ে তালাবন্ধ। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক ধাক্কা লেগে বুঝতে পেরেছি ভিতরে কিছু জমা আছে, তার বেশি নয়। সেদিন হঠাৎ সেরগেই-এর মুখের একটি কথা— Mircea, Mircea, Mircea, I have told my mother that you have only kissed me on my forehead”—একটি ভীত বালিকার মিথ্যাভাষণ একটা সোনার চাবি হয়ে সেই দুর্গম গুহার দরজা খুলে দিয়েছে—ভৈরব বেরিয়ে এসেছেন—আমি মহাকালের পায়ের শব্দ পাচ্ছিনটরাজ নাচছেন। তার এক পা অতীতে, এক পা বর্তমানে। তা তা থৈ থৈ’—আমার হীরা-পান্না ছড়িয়ে পড়ছে। হাসিকান্নার তরঙ্গ দুলছে—আমার বুকের হাড় গুঁড়িয়ে গেল, এ অসহ্য যন্ত্রণা। নটরাজ, তোমার নৃত্য থামাও, তুমি পা মুড়ে দাঁড়াও, কেশব হয়ে যাও, সব সন্তাপহারী শঙ্খ-চক্র–গদাপদ্মধারী, কিংবা বামনরূপে এস, তোমার তৃতীয় পা আমার মাথার উপর রাখ, আমি ঐ পশুর মতো তোমার পায়ের তলায় দলিত পিষ্ট হয়ে যাই! সকল কলুষ তামসহর সদয়হৃদয় বুদ্ধ হতে পার না? আমার দাহ জুড়িয়ে দিয়ে মোহাঞ্জন মুছিয়ে দিয়ে কেশবধৃতবুদ্ধশরীর, মুক্তি দাও আমায়, আমি আর ওকে দেখতে চাই না। আমি ঘুম ভেঙে আমার প্রতিদিনের সাজানো সংসারে আমার স্বামীর বুকে সন্তানদের কোলে, আমার আপনজনের মধ্যে জেগে উঠতে চাই।
ঐ তো মির্চা হেঁট হয়ে গ্যাস রিং-এ কফি বানাচ্ছে, খাবার ঘরের একপাশে গ্যাস রিং। রান্নাঘরের দরজার সামনে ঝড় দাঁড়িয়ে আছে, ঝড় আমাদের বাবুর্চি, ভীষণ কালো গোলগাল চেহারা, বুকে কেঁকড়া কোকড়া কালো লোম, ক্ষুদ্র একটি বনমানুষ। কিছুতে জামা গায় দেবে না—ওকে সভ্য করা গেল না। ও চিনি এগিয়ে দিচ্ছে। কফির ওপর ঘন ফেনা হলে তবে ওর ভালো লাগে, একে বলে টার্কিশ কফি, রোজ দুবেলা খাবার পরে ওর চাই। আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি, ও পকেট থেকে রুমাল বের করে সসপ্যানের ডাণ্ডাটা ধরেছে, অন্য হাতে পেয়ালা। চিনি নিয়ে ঝড় পিছন পিছন আসছে। ওর ফর্সা মুখে, কালো চশমার ফ্রেমে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ওটা কফির বাষ্প। মির্চা খাবার ঘরের টেবিলের কাছে চেয়ার টেনে বসল। আর ঠিক তখনই–
“নৃত্য পাগল নটরাজ যেন দুই হাতে দিয়ে তাল
দেখিনি আমরা তখনই সেখানে ঢুকেছিল মহাকাল
দেখব কি করে? আমরা তখন পরস্পরেরই দিদৃক্ষু
পতঙ্গ যেন বহ্নিমুখং বিবিক্ষু।
ভবানীপুরের খাবার ঘরের
টেবিলে সাজান চা
তুলে নিল কাল মহা অনন্তে
অব্যয় মহিমা!”
লাইব্রেরীতে ঢুকতে ঢুকতে আবার আমাদের ঝগড়া শুরু হল, শেষ হল উপরের বারান্দায়—মির্চা বললে, “কি, কথা বলবে না?”