আমি ‘ডাকঘরের কথা বলছি-ও বুঝতে পারছে না, সূকুটি করছে। কি হবে! এক সঙ্গে যদি সারাজীবন থাকতে হয়? অর্ধেক কথা না বলা থাকবে আর ক্রমাগত ডিকশনারী দেখতে হবে। এ আবার কি কথা মনে এল? এর সঙ্গে সারাজীবন থাকব কি করে? এতো কদিন পরেই চলে যাবে। আমারও বিয়ে হয়ে যাবে। কোথায় বিয়ে হবে কে জানে—একটা লোকও মনে করতে পারছি না, যার সঙ্গে সারাজীবন বাস করা সম্ভব।
“ভিতরে আসবে না অমৃতা? তোমার জন্য নট হামসুনের ‘হাঙ্গার’ বইটা এনেছি।
এই প্রথম ও আমাকে একটা কিছু উপহার দিল। আমি ওর হাত থেকে বইটা নিলাম। বইটাতে আমার নাম লিখেছে আর ফরাসীতে একটা কথা ‘আমিতিয়ে—
আমি দাঁড়িয়ে আছি। বসতে আমার সাহস হচ্ছে না। কেন কে জানে? সেও দাঁড়িয়ে আছে—আমি না বসলে তো বসবে না। আমি ওর দিকে পিছন ফিরে পিয়ানোর ডালাটা খুলে দাঁড়িয়ে আছি। আমি কি কিছুর জন্য অপেক্ষা করছি, একটা অসম্ভব কোনো ঘটনা কি ঘটবে? আমি কি তা চাই? ও আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আমাকে স্পর্শ করেনি। আমার পিঠে ও হাত রাখতে পারে কিন্তু রাখেনি। মাঝখানে একটুখানি আকাশ আছে, আমরা দাঁড়িয়েই আছি—আমার সর্বাঙ্গে আমি ওকে অনুভব করছি, মনের মধ্যে ওর অস্তিত্বের স্পর্শ লাগছে, এ কি ব্যাপার! আকাশ তো শূন্য নয়, ঈথারে পূর্ণ, ঈথার কি বস্তু আমি জানি না বটে তবু সে-ই নিশ্চয় অদৃশ্য হাতে এ সংযোগ করছে—আমার চারিদিক ওর নিশ্বাসের সুগন্ধে সুগন্ধি বায়ুমণ্ডল—
“সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার পরে,
অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে।”
উপর থেকে কে ডাকলো “রু রু রু——”
“যাচ্ছি”…
মির্চার বয়স তেইশ আর আমার ষোল। কিন্তু বয়সের পক্ষে আমরা দুজনেই একটু বেশী রকম তত্ত্বজ্ঞানী–বাবা আমাকে বলেন, “জ্যেষ্ঠতাত”। তা আমায় ‘জ্যেষ্ঠতাত’ বানাচ্ছে কে? বাবাই তো। আর ওকেও তাই বানাচ্ছেন, সব সময় অষ্টাঙ্গযোগের কথা হচ্ছে।
আর তন্ত্র সম্বন্ধে তো এ বাড়ির সবাই পণ্ডিত। কাকা যখন ওর সঙ্গে তন্ত্র নিয়ে আলোচনা জোড়েন গম্ভীর মুখে ‘হে বজ্রর’ রহস্য বিষয়ে, আমার রাগ হয়ে যায়। আমি তো জানি আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা এর চেয়ে অনেক হালকা সুরে কথা বলে। আমারও খুব পণ্ডিত হ’তে শখ ছিল। কিন্তু এখন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে মির্চার তত্ত্বে রুচি এত বেড়ে গেছে বলেই। দেখা হলেই বিশ্বসাহিত্য আমায় পড়িয়ে ফেলবে। কাল সারাক্ষণ একটা অদ্ভুত অলৌকিক গল্প আমায় বলেছে যার কোনো মানেই বুঝলাম না। একটা লোকের ফাসির হুকুম হয়, সে যে মেয়েকে ভালোবাসত সে অনেক দূরে থাকে। ফাসির মুহূর্তে তার সেই মেয়েটিকে মনে পড়ল। তারপর দশমাস পরে সেই মেয়েটির একটি ছেলে হল সে ঠিক ঐ লোকটার মত দেখতে। এ গল্পের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। আমার ইচ্ছা একটু স্বাভাবিক গল্প করুক, একটু খোসামোদ করলেই বা দোষ কি? যেমন অন্যরা করে। তা হবার তো নয়ই, উল্টে কাল আমায় খুব রাগিয়ে দিয়েছে, বলে কি, “তোমার কি ধারণা তুমি খুব সুন্দর দেখতে?”
“আমার ধারণা হতে যাবে কেন? আরো অনেকেরই ধারণা।”
“কার কার?”
“চল না আমর সঙ্গে রাস্তায়, দুধারে লোকেরা কিরকম তাকিয়ে থাকে দেখবে।”
“ও সে তো থাকবেই—তোমাদের দেশে যে রাস্তায় মেয়ে দেখাই যায় না। জানো ইউরোপ থেকে এসে সব চেয়ে কি আশ্চর্য লাগে—মনে হয় এদেশে কি মেয়ে নেই?”
“মেয়ে থাকবে না কেন? তারা ফিটন গাড়ি করে যায়—পাল্কী গাড়ি করে যায়—যাদের মোটর আছে মোটরে যায়, হেঁটে হেঁটে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে নাকি?”
“অন্য দেশে ঘোরে।”
“ঘুরুক। তুমি বুঝতে পার না আমি কালো কি ফর্সা? বাবা আমি সাবি মিলু মা সব এক? ঝড়ও আমার মতো?”
“আমি কোনো রঙের তফাৎ বুঝতে পারি না।”
“বেশ আমি চললাম।”
“বসো বসো লক্ষ্মীটি, আমি তোমাকে ভালো করে দেখি, বুঝতে পারি কি না।”
“ইস্ মাইক্রোসকোপ দিয়ে দেখতে হবে আমি সুন্দর কি না।”
“আমি তোমার বাইরেটা তো দেখি না, তোমার আত্মাকে দেখতে চাই।”
এবার আমার ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলে গেছে, জ্যেষ্ঠতাত, এবার জীবাত্মা পরমাত্মার বিতর্ক নিয়ে
আসে। আমি রাগ করে চলে গেলাম। আমার খুবই মন খারাপ হয়ে গেল। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি, বুঝতেই পারছি না—সত্যই আমি সুন্দর কিনা। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে—সমস্ত খুঁতগুলো চোখে পড়ছে। মীলু এসে বললে, “কি দেখছিস অত?”
“শোন ভাই আমাদের ভারতবর্ষে কত রকম পোশাক আছে—আমরা সব সময় এক রকম পোশাক পরি কেন? সেই এক হব করে শাড়ি পরা কিংবা বাংলা করে?”
“সত্যিই রাজপুতানীদের ঘাগরা সুন্দর, মারাঠীদের মতো বড় শাড়িও মন্দ নয়।”
মীলু আর আমি কিছুদিন থেকে গয়নার ডিজাইন নিয়ে পড়েছি। আমাদের সময়ে সাধারণত যেসব গয়না তৈরী হতো তা বিলাতী নকশা থেকে খুব কঁচা, অনুকরণ। তার সৌন্দর্য সৌকর্য কিছুই ছিল না। ঠিক সেই সময়টা অর্থাৎ আমাদের দু-তিন পুরুষ আগে থেকে শিল্পরুচির অধঃপতন হয়েছিল। ঠাকুরবাড়িতে তার পুনরুদ্ধার চলছিল। গৃহসজ্জায় বা দেহসজ্জায় খুঁজে খুঁজে পুরানো নকশার জিনিসপত্র, পুরানো ঘঁদের গয়নার চলন হচ্ছিল। তাকে বলা হতো ‘ওরিয়েন্টাল’। এ বিষয়ে স্টেলা ক্ৰামরিশ বিদগ্ধা—আমি আর মীলু সামান্যা নারী, আমরাও কিন্তু পুরানো রাজপুত রূপার গয়না থেকে নকশা নিয়ে, উড়িষ্যার রূপার গয়না থেকে নকশা নিয়ে, গয়না বানাতাম। খুব গয়না বানাতাম আমরা। কিই বা সোনার দাম ছিল, ১৮ টাকা ভরি! তারপর আমরা ঠিক করলাম রূপার গয়নাই বা পরব না কেন? সে সময়ে নিম্নবিত্ত মেয়েরা ছাড়া রূপার গয়না কেউ পরত না। আমরাই শুরু করেছিলাম, পরে খুব চলেছিল। গায়ের খাড়র সঙ্গে মখমলের চটি জুড়ে আমরা জুতো বানিয়েছিলাম, সেই ‘বকচ্ছপ’ বস্তুটি যে খুব চমৎকার হয়েছিল তা নয়, তবে লোকে তাকিয়ে থাকত ঠিকই। সেদিন আমরা ঠিক করলাম উড়িষ্যার মেয়েদের মতো সাজ করা যাক। শাড়ি খাটো করে অনেক গয়না পরা হল, আমার মার একটা সিঁথি ছিল। সিঁথির তিনটে ভাগ। সীমন্তের উপর দিয়ে একটা, আর দুপাশে দুটো হার, চলে গেছে—মাঝখানে একটা লকেট-কপালের উপর ঝোলে। বিয়ের সময় মাকে ঐ সিঁথি পরে দেখে বাবার এমন চোখে লেগেছিল যে সিঁথি সম্বন্ধে তাঁর মোহ ঘুচত না। মা তো আর পরতেন না, কিন্তু কোনো ছুতোয় আমায় ওটা পরাতে পারলে বাবা খুব খুশি হতেন। সেদিন আমি সিঁথি পরেছি, উড়িষ্যার শাড়ি পরেছি খাটো করে। কানের পাশ দিয়ে কদমফুল ঝুলিয়ে দিয়েছি। আর কদমফুলের রেণু আমরা মুখে মেখেছি। আমরা তো আজকাল সাবান মাখি না বিলিতি দ্রব্য ত্যাগ করেছি। মুখে মাখা হতো হেজলিন, আর জনসনের ট্যালকাম পাউডার। তাও আর স্পর্শ করা যাচ্ছে না। আপাতত কদমফুল পাওয়া গেছে, এ বেশ হয়েছে কিন্তু এ তো বেশি দিন থাকবে না।