একেক দিন অনেক রাত অবধি আমরা পড়ি; ন’টা দশটা, কেউ কিছু বলেন না বাবা মা কিছু বলেন না কিন্তু আমার নিজের একটা সঙ্কোচ অস্বস্তি হয়, কেউ যদি কিছু ভাবে! আমি দেখেছি ভৃত্যকুলের চোখে কৌতূহল আর আমার এগারো বছরের ছোট বোনের চোখে একটা সন্দেহ ও তীক্ষ্ণতা। মিষ্টি মেয়ে সাবি কিন্তু ওর সব সময় দুঃখ এবং অভিযোগ ওকে কেউ ভালোবাসে না, দিদিকেই সবাই ভালোবাসে। এখন মির্চা ইউক্লিডও সেই দিকে যাচ্ছে এটা ও বুঝতে পারে, তাই সাবি বলছে সেও ওকে বাংলা পড়াবে। ভালোই। ওর কাছে পড়লে তবু বিদ্যা হতে পারে—আমাদের পড়াশুনো তো বিশেষ এগুচ্ছে না। তবু মাস্টারমশাইয়ের কাছে সংস্কৃত পড়া হয়। মির্চা খুব ধাতুরূপ মুখস্থ করছে, ও আমায় হারিয়ে দেবে। ওর মতো অধ্যবসায় আমার নেই।
আমাদের বাড়িতে অনেক লোক একসঙ্গে বাস করি। এরা কেউ ঘনিষ্ঠ আত্মীয় নয়। তবে সেটা আমরা জানি না। সকলেই আপন। ও এটা ঠিকমতো বোঝে না। ওদের দেশে ‘কাজিন’ আর ‘ভাই দুটো কথা। যার সঙ্গে সম্পর্কও নেই সেও যে আমাদের ভাইয়ের মতোই আপন হতে পারে এটা ও বোঝে না। আমাদের যে বসুধৈব কুটুম্বকম্। তাই তো ওকে, সম্পূর্ণ বিদেশী হলেও বাড়ির সকলে এত আপন করে নিয়েছে।
কাকা আমাকে খুব স্নেহ করেন। আমরা যখন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ি তখন কাকা এসে গল্প জুড়ে দেন। মাস্টারমশাই গৌরমোহন ঘোষকে কাকা খুব ক্ষেপান। একদিন সকালে মাস্টারমশাই কপালে একটা চন্দনের টিপ পরে এসেছেন। গঙ্গাস্নান করে টিপ পরে তাকে বেশ পবিত্র দেখাচ্ছে। কাকা এসে ঝুপ করে হাঁটু গেড়ে বসে কৃতাঞ্জলি হতে বলতে লাগলন, “মাস্টারমশাই আমি বড় পাতকী, একটু পদরেণু”–মাস্টারমশাই বিব্রত হয়ে পা সরিয়ে নিচ্ছেন—“আঃ শ্রীশবাবু কি ছেলেমানুষী হচ্ছে।”
“মাস্টারমশাই পাপীতাপীকে ত্রাণ করবেন না?” কী করুণ আকুতি! আর আমরা দুই ছাত্রছাত্রী হেসে হেসে হয়রান হয়ে যাচ্ছি।
উপরে যেতে আমার মেজমাসী আমার দিকে ভূকুটি করে চাইলেন। উনি গতকাল এসেছেন। গতকাল থেকেই ওর সন্দিগ্ধ দৃষ্টি দেখছি আমি। বিরক্তিকর। মাসী বললেন, “ওই সাহেব ঘোড়াটার সঙ্গে অত কী হি হি করছিলি?”
আমিও দমবার পাত্রী নই। “সাহেব ছোড়া আবার কী? ওর নাম নেই নাকি!”
“এ্যাঃ নাম? একটু বেশি ধিঙ্গি হয়ে পড়েছ। নরেনবাবু মাথায় তুলে সর্বনাশ করছেন।”
মরুকগে, আমি আর এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে চাই না। ওর সঙ্গে তর্ক করে একটা বিশ্রী ব্যাপারও করতে চাই না। পালানই ভালো।
মির্চার ঘরের সামনের সরু গলিটা দিয়ে বেরিয়ে যে বারান্দা সেইখানে ‘চিঠির বাক্স’—ডাকওলা চিঠি দিয়ে যায় বাক্সটা চাবি বন্ধ, চাবিটা আমার কাছে থাকে—আমি দিনে দু-তিনবার ঐ বাক্সটা খুলে চিঠি সংগ্রহ করি। যদিও ডাকের তো একটা বিশেষ সময় আছে, যখন তখন বাক্স খোলার দরকার কি! কিন্তু আমি পারি না, দিনের মধ্যে অনেকবার মনে হয় যাই দেখে আসি চিঠি আছে কিনা। বিশেষত দুপুরবেলায় বাড়ি যখন শান্ত অর্ধস্তিমিত, অবশ্য নিদ্রিত নয়, আমাদের বাড়িতে কেউ দুপুরে ঘুমায় না, সবাই পড়ে, ৩খনই আমার ইচ্ছে করে চিঠির সন্ধানে যেতে। আমি জানি আমি কেন চিঠি দেখতে যাই, আমার তো বুদ্ধি আছে। নিজেকে আর কত ফঁাকি দেব? যদিও মির্চা বলেছে যে হয় আমি বোকা, নয় মিথ্যেবাদী। আমি জানি আমি কোনটাই নয়। আজকে দুপুরবেলা এমাগত মনে হচ্ছে চিঠি এসেছে কি না দেখে আসিবঙ্কিমচন্দ্রের গল্পের সুমতি কুমতির ঝগড়া চলেছে মনের মধ্যে—সুমতি বলছে, কখনো নয়, তুমি চিঠি দেখতে নয়, মির্চাকে দেখতে যেতে চাইছ—সত্যি কথা বল না কেন? আর কুমতি, মিথ্যেবাদী কুমতি বলছে, “পুর তা কেন, একটা চিঠি কারুর আসতেও তো পারে।
আমি উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম খিল লাগিয়ে। খাটের উপর বসলাম—নিজেকে আমার রক্ষা করতে হবে নিজের কাছ থেকেই। মহুয়াটা খুলে বসেছি—
“দূর মন্দিরে সিন্ধুকিনারে পথে চলিয়াছ তুমি–
আমি তরু, মোর ছায়া দিয়ে তারে
মৃত্তিকা তার চুমি,
হে তীর্থগামী তব সাধনার
অংশ কিছু বা রহিল আমার
পথ পাশে আমি তব যাত্রার
রহিব সাক্ষীরূপে–
তোমার পূজায় মোর কিছু যায়
ফুলের গন্ধ ধুপে।”
…এ আমার কথা নয়, এ আমার মার কথা। মা এই রকম ছায়া মেলে আছেন বাবার জীবনের উপরে, সন্তাপহরণ। নিজের জন্য কিছু চান না কিন্তু কি ভালোবাসা, কি ত্যাগ, কি অজস্র সেবা দিয়ে তাঁকে ঘিরে রেখেছেন। বাবার তীর্থযাত্রায় মার দান নিশ্চয় অনেক। মার জীবন উন্নত। স্বার্থহীন দানে পূর্ণ। কিন্তু আমি এটা চাই না। এ জীবন আমার কাম্য নয়। সবলা কবিতা আমার কথা বলেছে। নিজে নিজের ভাগ্যকে জয় করব। ইস্ কি বল—একটুও বল নেই, শক্তি নেই, বুদ্ধি নেই, আমি তো পরাজিত। হঠাৎ আমার কান্না পাচ্ছে—খাটের উপর পড়ে আমি কাঁদছি—“বল দাও মোরে বল দাও, প্রাণে দাও মোর শকতি…তব কাজ শিরে বহিতে সংসারতাপ সহিতে…’ সংসারতাপটা কি? এই যে আগুনের ঝাঁপট আমার শরীরে মনে লাগছে এটাই কি? তাহলে লাগুক লাগুক উত্তাপ—আমি চাই এই উষ্ণতা…‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’
হঠাৎ কখন নিচে নেমে এসেছি জানি না। দেখি পর্দা তুলে মির্চা দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে, “কি চিঠি পেলে?”।
“নাঃ এল না, কি হতাশ যে লাগছে।”
“কার চিঠির অপেক্ষা কর?”
“কোনো অজানা জনের।”
“সে কে?”
“জানি না, তাকে চিনি না বলেই অপেক্ষা এত মধুর।”