বাবা পরে ওকে বোঝালেন, “দেখ মির্চা, তুমি যে ভারতে এসেছ তা তোমার কথা শুনেই সবাই বুঝতে পারবে, তোমার ভিতরেও পরিবর্তন আসবে। সেটাই তো আসল। গায়ের রং ব্রাউন তো অন্যত্রও রোদে শুয়ে থেকে করা যায় কিন্তু আসল পরিবর্তন করবে ভারতীয় দর্শন, তুমি যা পড়েছ তাতেই রূপান্তর হবে।
তাছাড়া রেভলিউশন? রেভলিউশন দেখার জন্য দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নেই। ভারতে এখন সর্বত্র রেভলিউশন হচ্ছে। পিকেটিং আর কাঁদুনে গ্যাসই কি একমাত্র দ্রষ্টব্য বস্তু? এই যে তুমি আমাদের বাড়ি আছ, এটাই তো একটা রেভলিউশন-“আমার বাবার বাড়িতে কি থাকতে পারতে? তাহলে আমার স্ত্রী তোমার সামনে মুখ ঢেকে বেরুতেন, আর এই অমৃতা, ছেলেদের কলেজে গিয়ে কবিতা পড়ে, এ কখনো হতে পারত? তোমার বাসন আলাদা হতো, তুমি ছুঁয়ে দিলে ভাত ফেলা যেত—সে এক ব্যাপার, সে অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে আজ এই বাড়িই একটা রেভলিউশন।”
***
১.৩ সাহিত্য পরিষদের প্রকাণ্ড সাহিত্যসভা
সাহিত্য পরিষদের প্রকাণ্ড সাহিত্যসভা হবে, এখন যেখানে গোখেল মেমোরিয়াল স্কুল সেইখানে। এই প্রথম আমি স্বরচিত গদ্য প্রবন্ধ পড়ব—বিষয়বস্তু সুন্দরের স্থান কোথায়? সুন্দর কি বাইরে আছে? না মানুষের মনে? কথাটা নিয়ে এত ঘোরপ্যাচের দরকার কি? সুন্দর তো বহিবস্তু হতেই পারে না, মানুষই সুন্দর দেখে তার চোখে অর্থাৎ মনে নীলাঞ্জন মায়া। এই প্রবন্ধের জন্য আমি রীতিমত পরিশ্রম করছি—যা লিখছি বাবার পছন্দ হচ্ছে না—যা হোক শেষ পর্যন্ত খাড়া হয়েছে। এখন একটা পরীক্ষা সামনে। ঐ সভায় রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্ব করবার কথা ছিল কিন্তু তিনি আসতে পারবেন না, হায়দ্রাবাদে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এই নিয়ে অকুস্থলে অর্থাৎ সাহিত্যসভায় খুব নিন্দা হবে তার। রবীন্দ্রনাথকে দু-কথা শোনাতে কেউ ছাড়ে না এদেশে। আমি অবাক হয়ে দেখি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে, তার কাছে একবার যেতে সবাই উদগ্রীব, সামনে গেলে তো বিগলিত কিন্তু আড়ালে নিন্দা করতে সহস্রমুখ। ওঁর সম্বন্ধে বাবারও অনেকটা এরকম ভাব আছে। বাবা এত পড়েছেন রবীন্দ্রকাব্য, এত আলোচনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আকর্ষণেরও অন্ত নেই, অথচ সমালোচনা চলে নিরবচ্ছিন্ন, বিশেষ করে আমাকে বিধিয়ে বিধিয়ে শোনানো হয়, যেম আমি তাঁর ‘স্বলন-পতন-ত্রুটির’ জন্য দায়ী।
সভাক্ষেত্রে হলও তাই। নানা অপ্রীতিকর মন্তব্য হল—আমার মনটা বিষণ্ণ, যদিও ঐ দিন আমি খুবই পুরস্কৃত হয়েছি—এতবড় সভায় এর আগে আমি কখনো গদ্য প্রবন্ধ পড়ি নি। কবিতা অবশ্য পড়েছি অনেক, সেনেট হলেও। সেদিন আমিই কনিষ্ঠ সাহিত্যিক, জ্যেষ্ঠা ছিলেন মানকুমারী বসু-মধুসূদনের ভাইঝি। বিধবার থান বাংলা করে পরে খালি পায়ে তিনি সভাস্থ মঞ্চে কবিতা পড়লেন। দুই যুগের কী পরিবর্তন! আমি ভাবলাম মির্চা এ রেভলিউশনটা দেখলে বুঝত।
বাড়ি ফিরে দেখি সে চুপচাপ বসে আছে। এখানে ও একা, বন্ধুবান্ধব নেই আমরা ছাড়া। তাই ওকে বললাম চল বারান্দায় বসে গল্প করা যাবে।
নানা কথার মধ্যে মির্চা হঠাৎ আমায় জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি এত বিষণ্ণ কেন?”
আমি ওকে বললাম সভায় যা যা হয়েছে—সভায় কিভাবে তাকে নিন্দা করা হয়েছে, তিনি কথা রাখতে পারেন নি বলে। এবার বিষণ্ণ হবার পালা ওর। দু-একটা কথার পর বলল—“একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধ মানুষকে তুমি এইটুকু মেয়ে এত ভালোবাস কি করে?”
রাগে আমার কান ঝা ঝা করছে, “কেন? বেশি বয়স হলে মানুষ ভালোবাসা পাবার অযোগ্য হয়ে যায় নাকি?”
ও একটু উত্তেজিত, “দেখো অমৃতা—হয় তুমি নিজেকে চেন না, নয় তুমি নিজেকে ঠকাও, কারণ সত্যকে দেখবার সাহস তোমার নেই, কিম্বা জেনেও মিথ্যা কথা বলছ।”
“মির্চা, আমার অসম্ভব মাথা ধরেছে তুমি একটু চুপ কর।”
বাবা বলেছেন, “রু, তুমি মির্চার কাছে একটু ফ্রেঞ্চ শেখ, ফ্রেঞ্চ না শিখলে একমপ্লিশমেন্ট পূর্ণ হয় না।” বাবা আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। অনাদি দস্তিদার বাড়িতে আসেন গান শেখাতে, রমেন চক্রবর্তী আসেন ছবি আঁকা শেখাতে, একজন গোয়ানিজ মাস্টার ভায়োলীন বাজান শেখাতে! এত বিদ্যা সামলানই আমার দায় হয়েছে, এদিকে আমার কিছু ভালো লাগে না এসব করতে, আমার কোনো অধ্যবসায় নেই কবিতার বই হাতে নিয়ে জানালার ধারে বসে—মন ভেসে যায় কোন সুদুর। যাক, মির্চা আমার কাছে বাংলা শিখবে, আমি ওর কাছে ফ্রেঞ্চ। খুব সাধু সংকল্প নিয়ে পড়তে বসা হয়, পড়া আর এগোয় না। কেন যে এগোয় না কে জানে! ওর ঘরেই আমরা পড়তে বসি, মাঝখানে একটা বাতি জ্বলে, স্ট্যাণ্ডিং ল্যাম্প, কতদিন কত রাত হয়ে যায় বলাকার কবিতা পড়ি আমি, ও শুনতে ভালোবাসে কিন্তু অন্য ভাষায় ঐ কবিতা বোঝানো কি আমার সাধ্য—একটা কবিতা ও বুঝতে পেরেছে, ওর খুব ভালো লেগেছে–
“পাখিরে দিয়েছ গান পাখি গায় গান।
তার বেশি করে না সে দান।
আমারে দিয়েছ স্বর আমি তারও বেশি করি দান
আমি গাই গান।”
মানুষ যা পেয়েছে শুধু সেইটুকুতে সন্তুষ্ট নয়, সে যে সৃষ্টিকর্তা। দুঃখকে আনন্দ করবার ভার তার হাতে।
“দুঃখখানি দিলে মোর তপ্তভালে থুয়ে
অশ্রুজলে তারে ধুয়ে ধুয়ে
আনন্দ করিয়া তারে ফিরায়ে আনিয়া দিই হাতে—
দিনশেষে মিলনের রাতে।”
এ কবিতা আমি পড়ি তবু এর তাৎপর্য বোঝবার বয়স আমার নয়। তবে আনন্দ আর দুঃখ যে মিলে মিশে যায় এটুকু আমি বুঝতে পারছি।