“বলো—”
“এদিকে তাকাও”-“আমি ঘুরে বসে ওর দিকে তাকালাম—ও স্থির অপলক আমার দিকে চেয়ে রইল সম্মোহিত দৃষ্টি। আমি দেখতে পাচ্ছি ওকে, এখনও ঠিক তেমনি দেখতে। পাচ্ছি—ওপরের বাঙ্কের দড়িটা ধরে একটু ঝুঁকে আমার দিকে চেয়ে আছে। একটু পরে আমরা দুজনেই হেসে ফেললাম।
“কি ভাবছিলে এতক্ষণ?”
“একটা গান মনে করবার চেষ্টা করছিলাম।”
বাবা বেরিয়ে এলেন—“কি বলছিস তোরা?”
“বাবা ইউক্লিডকে ঐ গানটা অনুবাদ করে দাও না, আমার দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদল সঁঝে।”
“তুমি কর, তুমিই বা পারবে না কেন—” তারপর এ আমার অসাধ্য বুঝে বাবা বলতে লাগলেন, “আচ্ছা, ‘বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা…গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা’…বর্ষার বর্ণনায় বিরহের কথা আসতেই হবে বর্ষা বিরহীর মনকে সন্তপ্ত করে, পযুৎসুকী করে”বাবা মেঘদূতের কথা বলতে লাগলেন—“এদিকে বলা হচ্ছে, বিরহ ব্যথার মালা’, অন্যদিকে ‘গোপন মিলনের কথা! মিলন ও বিরহ এই দুই বিপরীত ভাব দিয়ে একটা সম্পূর্ণতা বোঝান হচ্ছে।” রবীন্দ্রকাব্য বিপরীতের প্রয়োগ সম্বন্ধে বাবা খুব ভালো করে বলতে লাগলেন।
কিন্তু আজকের দিনে এই দ্বিতীয়বার তাল কাটল। এত কথার দরকার কি—আজ যে মুহূর্তে মির্চা আমার চোখের দিকে তাকিয়েছে আমি বুঝতে পেরেছি বিরহ ও মিলন একসঙ্গে কি করে থাকে, আর তার ব্যাকুলতাই বা কি। আমি ওর ফর্সা গলার উপর সেই অদৃশ্য মালার সুগন্ধ পাচ্ছি…‘গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা’…
মির্চা আমাদের বাড়ি আসবার কত পরে আমার ঠিক মনে নেই, ও প্রথম একটা কাণ্ড করল। খাবার টেবিলের এক মাথায় বাবা বসে আছেন, উল্টো মাথায় মা, মাঝখানে মুখোমুখি ও আর আমি। সে আস্তে আস্তে তার পা বাড়িয়ে দিয়ে আমার পায়ের উপর রাখল। আমি পা সরিয়ে নিলাম, আমি ভাবতে চাইলাম দৈবাৎ লেগে গিয়েছে—যদিও আমার শরীর-মন চমকে উঠল, কিন্তু কি আশ্চর্য সেই মুহূর্তে ওর দিকে চেয়ে আমার হঠাৎ মনে হল—এ চলে গেলে আমি বাঁচব কি করে? খাবার টেবিল থেকে সবাই উঠে গেলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম—“তোমার পা কি হঠাৎ লেগে গিয়েছিল? তা তো নয়।”
“না, তা নয়।”
“কী স্পর্ধা! কী সাহস! যদি বাবার পায়ে লাগত কি হতো তাহলে?”
“কিছুই হতো না। আমি তৎক্ষণাৎ প্রণাম করতাম।”
“তুমি বুঝতে কি করে?”
“হাঃ, হাঃ, হাঃ, তোমার বাবার পা আর তোমার পা বুঝতে পারব না!” এই বলে সে তার পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে আবার আমার পায়ের উপর রাখল।
তেতাল্লিশ বছর আগের ঘটনা! কী আশ্চর্য! কী বিস্ময়! আমি সেই টেবিলে বসে আছি—আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি। ও একটা পাঞ্জাবী পরেছে, ওর বুকটা খোলা, ওর ফর্সা গলাটা আমি দেখছি—ওর হাত দুটো টেবিলের উপর, আমার হাত ধরবার ওর সাহস নেই। আমি পা দুটো সরিয়ে নেবার চেষ্টা করছি—পারছি না, পারছি না, একি অন্যায়! একি পাপ? কি করি এখন? মা বলেছিলেন অনাত্মীয় কোনো পুরুষ মানুষকে ছোঁবে না, তাহলে শরীর খারাপ হয়ে যায়—কথাটা ঠিকই। আমার শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে কিন্তু ও পা সরাচ্ছে না—আমার পায়ের উপর তা দৃঢ়সংবদ্ধ, এখনও, এই এখানে, এইখানেই–
আমার কপালের উপর একটা ঠাণ্ডা হাত কে রাখল, আমি যুগান্তরের ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। পাশে দাঁড়িয়ে আছে লেখা। সে আস্তে আস্তে বললে, “মা আপনার এমন কেউ নেই, যাকে মনের কথা সব বলতে পারেন? বোনকে, মেয়েকে, বন্ধুদের? আপনার কি হয়েছে কাউকে না বললে তো হবে না।”
স্বাধীনতাযুদ্ধের নানা রকম হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে, হিংস্র এবং অহিংস দুই-ই। প্রেসিডেন্সি কলেজে হাঙ্গামা লেগেই আছে। একদিন ছেলেরা অধ্যক্ষ স্টেপলটনের রক্ত চেয়েছিল। আজকালকার মতো সে রকম ঘটনা তখন হামেশা ঘটত না। যদিও বাবার সাথে স্টেপলটনের শতা খুবই, তবুও সেদিন তিনি তাকে বাচিয়েছিলেন। কলেজের হাতার মধ্যে পুলিশের গুলিতে একটি ছেলে আহত হলে ক্রুদ্ধ ছাত্রের দল কলেজ ঘিরে ফেলে। তখন পুলিশ চলে গেছে, ছাত্রদের দাবী ঐ আহত ছেলেটির রক্তের সঙ্গে স্টেপলটুনের রক্ত মেশাতে হবে। তখন বাবা মধ্যস্থতা করেন যে স্টেপলটনকে নিরাপদে বের করে নিয়ে আসবেন যদি তিনি ঐ আহত ছেলেটির কাছে ক্ষমা চান। সে সময়ে ঐটুকুতেই হতো। স্টেপলটন রাজী হলেন, তারপর গাড়িতে উঠেই অন্য মূর্তি, বলেন কি আমি পরে ক্ষমা চাইব। বাবা তখন বললেন, “ঠিক আছে তাহলে আমি এখনই নেমে যাচ্ছি, তুমি ছাত্রদের সঙ্গে বোঝাঁপড়া কর।” স্টেপলটন বাবাকে কিছুতে ছাড়বেন না। উনিও নেমে যাবেনই, তখন তিনি তাঁর কোট ধরে ঝুলে পড়লেন, বাবা নিরুপায় হয়ে কোটটি খুলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই কোট ধরে ঝোলার হাস্যকর ব্যাপারটি বাবা সেদিন খাবার টেবিলে সবিস্তারে বলে আমাদের খুব হাসিয়েছিলেন। মির্চা তখনই ঠিক করল যে পরের দিন রেভলিউশন’ দেখতে যাবে।
বলা নেই কওয়া নেই সকালে সে বেরিয়েছে, সারাদিন কেটে গেল, সবাই উদ্বিগ্ন। মা ঘরবাইর করছেন, পরের ছেলে বিপদে পড়ল কিনা। কাকা যখন পুলিশে খবর দিতে যাবেন এমন সময় মূর্তিমান এসে হাজির, ধূলি-ধূসরিত, সারাদিন ঘুরে উস্কোখুস্কো এবং নিরতিশয় হতাশ। যেখানে সেখানে পিকেটিং হচ্ছে ঘুরেছে, পথে পথে ঘুরেছে বিপদের সন্ধানে কিন্তু কোনো বিপদ হয়নি। উপরের জানালা দিয়ে কেউ একজন একটা দই-এর ভঁড় ফেলেছিল, সেটাও ওর গায়ে পড়ল না, পড়ল কিনা সামনে। এমন কিছু ঘটল না যাতে দেশে ফিরে গিয়ে কোন চিহ্ন দেখাতে পারে। ওর ভয়, দেশে সবাই বলবে, ভারতে যখন রেভলিউশন হচ্ছিল তখন তুমি কোন গর্তে লুকিয়েছিলে? সে যে ভারতে এসেছিল এটা নিজের দেশের লোককে কি করে বিশ্বাস করাবে এই ওর এক ভাবনা। কারণ ওর দেশ থেকে এই প্রথম কেউ ভারতে এসেছে। এদিকে চামড়াও যথেষ্ট রোদে পোড়া হচ্ছে না। তাই একদিন সকালে উঠে একটি মাদুর নিয়ে ছাতে চলে গেল, সেখানে মুখের উপর একটা ভোয়ালে চাপা দিয়ে বেলা দুপুর অবধি শুয়ে রইল। তারপর বিকেলবেলা তার সারা গায়ে ফোস্কা পড়ে গেল। আমরা ছোটরা খুব হাসছি, বিশেষ যে সহানুভূতি আছে। তা নয়। মা খুব উদ্বিগ্ন, এ ছেলে তো পাগলামি শুরু করেছে। ইয়োরোপের একটি দুরন্ত ছেলেকে সামলোনো কঠিন, বিশেষ করে ভাষাটাও তেমন রপ্ত নেই। চাঁদসীর মলম এল। মা দেখিয়ে দিলেন, কাকা লাগাতে লাগাতে মার ভর্ৎসনাগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে লাগলেন।