কবির কাছ থেকে এসে বাবা মির্চাকে নিয়ে লাইব্রেরী দেখাতে গেলেন। ও পুঁথির সংগ্রহ দেখবে। জ্ঞানের জন্য ওর আকণ্ঠ তৃষ্ণা। বাবা এই ছাত্র নিয়ে খুব গর্বিত। বাবার প্রদর্শনীতে আমরা দুজনেই দ্রষ্টব্য বস্তু।
কবি বড় জানালার কাছে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে চেয়েছিলেন, আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে পায়ের কাছে একগুচ্ছ ফুল রাখলাম। উনি হাত বাড়িয়ে দিলেন—“হাতে দাও।”
আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন! মৃদু মৃদু হাসছেন অর্থপূর্ণ হাসি—“কি গো, সাহেবের সঙ্গে কি গল্প হচ্ছিল? কত কথা বলছিলে? কথার ফুলঝুরি। আমি সাহেবকে বলেছি, মেয়েদের কথা খানিকটা বাদ দিয়ে বিশ্বাস করবে। যত পদচারণা তত বাক্যচারণা।”,
“আপনি কি করে দেখতে পেলেন?”
“কেন দেখতে দিতে চাও নি নাকি? তাহলে আর একটু সাবধান হতে হতো।”
আমি লক্ষ্য করলাম জানালা দিয়ে নিচের বাগানের হাতাটা দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ।
“আঃ আমার রাগ হচ্ছে।”
“তাতো হচ্ছেই, কি রকম রাগ?”
উনি আমার কাপড়ের আঁচলটা ধরে বললেন, “একি নীলাম্বরী?” তার পর গান করে, “পিনহ চারু নীল বাস, হৃদয়ে প্রণয় কুসুম রাশ” —আমার কান ঝাঝা করছে, বুক ধ্বক ধ্বক করছে, পরিহাসটা ভালো লাগছে কিন্তু সহ্য করতে পারছি না, মাথাটা সামনে ঝুঁকে পড়েছে, উনি আমার বিনুনীটা ধরে টান দিয়ে মুখটা ঊর্ধ্বমুখী করে দিলেন। আমি চোখ বুজে আছি। ওর চোখের দিকে তাকাবার আমার সাহস নেই—আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এইবার উনি আমার বিনুনীটা ছেড়ে দিলেন—“দ্যাখো কাণ্ড! কাঁদে কেন?”
আমি যা যা বলব ভেবেছিলাম সব ভুলে গেলাম। কিছু আমার মনে পড়ছে না, আমি ওর হাঁটুর উপর মুখ রাখলাম। উনি আমার মাথায় তার অভয় হস্ত রেখে আস্তে আস্তে বলতে লাগলেন, “অমৃতা তোমার বয়স অল্প। মনটাকে নিয়ে এত নাড়াচাড়া করো না, সেটা স্বাস্থ্যকর নয়। মনটা স্বচ্ছ কাকচক্ষু সরোবরের মতো স্থির রাখ, তার নিচে বহুদূর গভীরতা, কিন্তু এখনই তাকে চঞ্চল করে উত্তাল করার দরকার নেই শান্ত হয়ে থাক। সে মনে বাইরের নানা ছায়া পড়বে সহজভাবে তা গ্রহণ কর, সেই যে আমি লিখেছি—“সত্যেরে লও সহজে’—তোমার নিজের ভিতরে যে মাধুরীলতা আছে দূরে নেমে যাবে তার মূল তার উপরে ফুল ফুটবে। অপেক্ষা কর। এখন উঠে বসো একটু গল্প করা যাক।… তোমার ছাতিমগাছটা কেমন আছে?”
“আমরা তো এখন আর সে বাড়িতে নেই।”
আমাদের আগের বাড়িতে একটা ছোট্ট ছাতিমগাছ ছিল। আমি সেই গাছটার উপর একটা কবিতা লিখেছিলাম, কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ভালো লেগেছিল। মির্চা সেই কবিতা শুনে অবাক, বলে ‘প্যানথীঈজম’। প্যানথীঈজম, বস্তুটি কি তখন জানতাম না। গাছের সাথে একটি মেয়ের প্রেমের কথাটিকে এই লাইনটা ওকে ভাবিয়েছিল, এর অর্থ কি? এটা যে কোনো ইজম নয়, কেবল মাত্র কবিত্ব, তা ও বুঝতে পারে না।
সেদিন গেস্ট হাউসে ফিরে বাবার কাছে প্রচণ্ড বকুনী খেলাম, দেরী করেছি বলে—দেরী হওয়াতে কিন্তু কিছুই ক্ষতি হয় নি—ট্রেনও ফেল করব না, বা কারু কোনো বিপদও হচ্ছে না। তবু হঠাৎ চটে গেলেন। বাবা যখন রেগে যান তখন কোনো জ্ঞান থাকে না। আমাকে এত বকতে লাগলেন যে আমি অপদস্থ বিপর্যস্ত হয়ে গেলাম, মির্চাও করুণভাবে আমার অবস্থা দেখতে লাগল। সকালবেলার সুন্দর সুরটা কেটে গেল। সুর কাটতে, তাল ভাঙ্গতে, বাবার জুড়ি নেই—ইন্দ্রসভা হলে ওর মর্তে নির্বাসন হতো। কিন্তু এটা তো ইন্দ্রসভানয়—ওরই নিজের সংসার। এখানে সকলকেই মাথা নিচু করে সয়ে যেতে হয়।
সেদিন ট্রেনে উঠে বাবা ক্রমাগত শান্তিনিকেতনের নিন্দা করতে লাগলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠান টিকবে না, টিকতে পারে না, কবি যেদিন চক্ষু বুঝবেন তার পরদিনই উঠে যাবে। মির্চা চুপ করে শুনছে, মাঝে মাঝে সায়ও দিচ্ছে। বাবা আরো বলে চলেছেন—এইবার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে কাব্য নিয়ে পড়েছেন, প্রার্থনা কবিতার ঐ লাইনটা দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়, অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়’—ঐ চরিতার্থতা’ শব্দটা নাকি যথেষ্ট কাব্যগন্ধী নয়। ওটার প্রয়োগ একেবারে ভালো হয় নি। তা হতে পারে। আমি এখন কাব্যবিচার শুনতে চাই না। আমি রেলগাড়ির জানালায় মাথা রেখে ওদের দিকে পেছন ফিরে বসে দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছি। রেলগাড়ির চাকা ধ্বধ্বক চলেছে। গাড়ির চাকা কথা বলে, গান করে। আমার মনে একটা গান গুন গুন করছে–কোন দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে…তিমির আড়ালে…এ…এ… নীরবে দাঁড়ায়ে আছে’—তখন রবীন্দ্রনাথের গান এত শোনা যেত না, ক’জন গাইত? হঠাৎ কখনো ওর গান শুনলে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠত—এ গানটা মাত্র গত সপ্তাহে শুনেছি, কালিদাসবাবুর কাছে। কালিদাসবাবু খুব মিষ্টি গান করনে। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম, উনি সেকালের ঠাকুরবাড়ির গল্প করেন— আমি প্রায়ই বিকেলে ওখানে যাই। সেদিন তিনি ছিলেন না অপেক্ষা করে করে সন্ধ্যা হয়ে গেল, তাই কালিদাসবাবু আমায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন। রমেশ মিত্র পার্কটা পার হতে হতে গুনগুন করে উনি গাইছিলেন—“বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা গোপন মিলন অমৃত গন্ধ ঢালা’—আমার কানে সুরটা রয়েছে আমি গুনগুন করে গলায় তোলবার চেষ্টা করছি। তিমির আড়ালে…রেলের চাকা বলছে…নীরবে দাঁড়ায়ে আছে। বাবা উঠে বাথরুমে ঢুকলেন—মির্চা এসে আমার পিছনে দাঁড়াল,“অমৃতা”