“আমার কিছু হয়নি লেখা, কিছু না।”
“দেখি তুলে তার বুকের আচ্ছাদন,
সেখানে এখনও বাস করে কিনা মন,
হন্যমান এ শরীরের মাঝে যার
অজর অমর সত্তার সম্ভার
পদে পদে গায় অসম্ভবের গান,
তাই শুনতেই আজো পেতে আছি কান”
অসম্ভব, অসম্ভব। জীবন কী অসম্ভবের সম্ভাবনায় পূর্ণ—এত কাল পরে কি এমন করে সব মনে আসতে পারে—এত বেদনা নিয়ে, এত রক্তক্ষরণ হয়?…
“মা, কি বলছেন চোখ বুজে মন্ত্র জপ করছেন নাকি?”
“কবিতা, কবিতা, অনেক দিন পরে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে—
শস্ত্র ঘেঁড়ে না, অগ্নি দহে না যারে
দেখব তারেই অশ্রুর পারাবারে
পাগলের মতো দু-হাত বাড়ায়ে ধরে–
অধরা প্রাণের আবার স্বয়ংবরে
চলো যাই দূরে যেখানে দাঁড়ায়ে কাল
ভেঙ্গে চুরে দিয়ে ঝেড়ে ফেলে জঞ্জাল
শুধু হাতে নিয়ে মুক্ত প্রাণের দীপ
নূতন বধূর কপালে পরাবে টিপ…
সেখানে যাবই যেখানে রয়েছে থেমে
বাসররাত্রি, অবিচল কারু প্রেমে…”
এতক্ষণে বুঝতে পারছি কেন আজ এক বছর ধরে আমার মনে মনে ক্রমে ক্রমে কোথাও যাবার ইচ্ছাটা এত প্রবল, এত দুর্দমনীয় হয়ে উঠছে। কেবল মনে হয় কোথাও যাই, কোথাও যাই, দূরে–অনেক দূরে—আর এখন মনে হচ্ছে এই বারান্দাটা দিয়ে বেরিয়ে আকাশে ভেসে কোথাও চলে যাই—
লেখা বলছে, “শুতে চলুন।”
আমি বলছি, “চলো যাই, চলো যাই, চলো যাই।”
আমি হাসছি। লেখাও হাসছে—“চলুন, শুয়ে পড়বেন চলুন।”
রাত্রি অনেক হয়েছে, আমার স্বামী ঘুমোন নি। সেপ্টেম্বর মাসে সেরগেই এসেছিল, আজ অক্টোবর শুরু। এই এক মাস পর উনি লক্ষ্য করেছেন আমি এখানে নেই। কি হয়েছে উনি জিজ্ঞাসা করতে পারছেন না। সেটা ওঁর স্বভাব নয়—এই দীর্ঘ আটত্রিশ বছর আমাদের বিবাহ হয়েছে, এর মধ্যে আমাদের যুক্ত জীবনে কোনো দ্বন্ধ নেই। উনি নিশ্চয় কোনো এক রকম করে জানেন যে এই সংসারে আমি একান্ত সংসারী গৃহিণী হয়েও আমার কিছুটা বাকি আছে—যার খবর উনি জানেন না। তাতে ওঁর কিছু আসে যায় না, কারণ উনি দিতেই জানেন, দাবী করতে জানেন না। আমি জানি ওকে সংশয়ে রাখা উচিত নয়। আমার কিছু বলা উচিত, কিন্তু এতদিন পরে আমি কি বলব? ওর বইটার কথা কি করে বলব? মির্চা, তুমি এত মিথ্যা কথা লিখলে কেন? যা সত্য ছিল তাই কি যথেষ্ট নয়? মিথ্যা কথা লেখা হয়েছে গল্প বাজারে কাটবে বলে। আজকাল তো দেখি অসভ্যতা করলে বইয়ের কদর হয় না—তোমাদের দেশ থেকেই তো রুচিবিকার আমদানি হয়েছে কদর্য, দেহবদ্ধ প্রেমের নির্লজ্জতা। হায় হায়! তুমি শেষটায় আমায় তার মধ্যে নামিয়েছ। সত্যের দায় আমি নিতে পারি, মিথ্যার দায় বইব কি করে? আমার ভবিষ্যৎ আছে, নামখ্যাতি আছে, ছেলেমেয়ে আছে, আমি ভারতীয় নারী, সুনাম নষ্ট হওয়া তো মৃত্যুর অধিক। অপমানে আমার সারা শরীর গরম হয়ে যায়—অমি মুখে চোখে জল দিয়ে আসি। আজ এক মাস হয়ে গেল, একটি রাতও আমি ঘুমোতে পারছি না। ক্রোধের দাহ জ্বলছে। সে জ্বালায় জ্বলছে অনেক কিছু। আজ চল্লিশ বছর ধরে আমার যে মান সম্মান সম্রম, সমস্ত নষ্ট হতে চলেছে—তোমার বইয়ের কুড়িটা এডিশন হয়েছে, বহুজনের সামনে তুমি আমায় বিবস্ত্র করেছ—একে ভালোবাসা বলে নাকি? বইটা আমি পড়িনি তবে যা শুনলাম তাতে তাই তো মনে হচ্ছে বইটা যোগাড় করে পড়তে হবে। কিন্তু পড়ে দেবে কে? ঐ ভাষা তো আমরা কেউ জানি না। আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছি। ওর মুখটা মনে করবার চেষ্টা করছি, মুখই যদি মনে পড়ে তবে ঝগড়া করব কার সঙ্গে? আমার ওর মুখ ভালো করে মনে পড়ছে না—সে যে অনেক দিন হয়ে গেল—কেবল দেখি পার্টিশনে হেলান দিয়ে ও বসে আছে, ওর সেই বকের পালকের মতো সাদা পা দুটো।…আমি জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। আজকাল জানালায় শিক থাকে না, থাকে গ্রীল—ওটা ধরে দাঁড়ান যায় না। উন্মুখ মন যখন জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চায় তখন গরাদ ধরে শক্তি পাওয়া যায়। নন্দলালের একটা ছবি আছে, রাত্রির অন্ধকারের আবছা মূর্তি বন্দিনী সীতা একটা গরাদ ধরে আছে—আমার নিজেকে তেমনি মনে হচ্ছে—এই গরাদ খুলে দাও—যাই, যাই, সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে, আমার এই চল্লিশ বছরের সংসার ছেড়ে, আমার নাম খ্যাতি কর্তব্য ছেড়ে চলে যাই, চলো যাই, চলো যাই—মির্চা তোমায় একবার দেখতে চাই।
আমি বাবাকে বললাম, “রবীন্দ্রনাথ বিদেশে যাবার আগে আমরা কি একবার তার সঙ্গে দেখা করতে যাব না?”
“নিশ্চয়ই, ইউক্লিডও যেতে চায়। তাকে লেখা হল—যথারীতি একদিন পরই উত্তর এল—“তথাস্তু। সকন্যক, সশিষ্য, এসো।”
সে বারে আমরা বড় গেস্ট হাউসে উঠেছিলাম। সকালবেলা উত্তরায়ণে দেখা করতে যাব আমরা তিনজন, আমি মির্চা আর বাবা। আমি আর মির্চা একটু আগে বেরিয়ে পড়েছি, বাগানে টেনিস কোর্টের কাছে পায়চারী করছি, বাবা আর আসছেনই না, সম্ভবত পথে ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে দেখা হয়েছে—ভালোই হয়েছে, তাতে আমরা ক্ষুন্ন নই। কি সুন্দর সকালটা কলকাতার পর, শান্তিনিকেতন আমাদের দুজনকে যেন আলিঙ্গন করছে, ‘তার আকাশ ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে–।
বাবা এলেন, “চল”। আমি বললাম, “আমি পরে যাব, তোমরা যাও। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে আসি-” আমি ওদের সঙ্গে যাব না। আমার একলা কথা বলার আছে। আমি অবশ্য কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি না। এখানে আমার কোনো বন্ধু নেই—আমি দু-তিন দিনের জন্য আসি, তখন আবার কোন্ বন্ধুর সন্ধানে যাব? একটি যে আছেন একাই একশ! মাত্র একশ?