যা ভয় করেছি তাই। পর্দা সরিয়ে মির্চা বেরিয়ে এল, এক পা এগিয়ে ওকে দেখেই আবার ঘরে ঢুকে গেল। রীতিমত অভদ্রতা। ‘ম’ বাবু কি ভাবল! মহাবিপদ এদের নিয়ে, এরা সবাই সমান। আমি অস্থির হয়ে উঠলাম, “যান না উপরে, মা উপরে আছেন, এখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যাথা করবার দরকার কি?”
“আপনার পা ব্যাথা হয় না? না, কারু জন্য অপেক্ষা করছেন? আমি প্রতিবন্ধক?”
‘ম’ বাবু ভিতরে চলে গেল, আহত, বাণবিদ্ধ।
আমার কান্না পাচ্ছে, খুবই কান্না পাচ্ছে, এদের কথা আমার ভাববার দরকার কি! এরা কে কি ভাবল তাতে কি এসে যায়। আমার কি ভাববার কিছু নেই? কতদিন হয়ে গেল আমি শান্তিনিকেতনে যাইনি।
ওখানে না গেলে আমার মন শান্ত হবে না।’শান্তিনিকেতনে ছাতিমতলায় যে পাথরের ফলকে লেখা আছে—
“তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।” মহর্ষিদেব ঈশ্বরকে চিনতেন, তিনিই তার প্রাণের আরাম ছিলেন—হবেও বা। আমি তো ঈশ্বরকে চিনি না। বাবা সেদিন থিয়লজিয়ানদের যুক্তি বোঝাচ্ছিলেন-কানের ভিতর যে যন্ত্রটা নিপুণভাবে তৈরী, যে হ্যামার আর এনভিল বসানো আছে, সে কি অমনি হয়েছে? কেউ তো করেছে, সে কে? এটাই একটা ঈশ্বরের অস্তিত্বের অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ। অমন করেও হয়তো ঈশ্বরের প্রমাণ হয়, কিন্তু সে ঈশ্বর কি প্রাণের আরাম হতে পারে? যাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়,যাকে দেখলে বাতাস মধুর হয়—দূর ছাই, শ্রাদ্ধের মন্ত্র মনে আসে কেন কে জানে–আসলে এটা তো প্রেমের মন্ত্র। সেদিন স্টোর রোডের বড় লাল বাড়িটাতে আমরা গিয়েছিলাম, কলকাতার সব ‘এলিট’রা এসেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেনের গান শুনতে, অতুলপ্রসাদ সেন হারমনিয়াম বাজিয়ে গাইছিলেন—“তুমি মধু, তুমি মধু, তুমি মধুর নিঝর, মধুর সায়র আমার পরাণ বঁধু-”উনি নিশ্চয় ঈশ্বরের কথা বলছিলেন। বৈষ্ণবসাহিত্যে বঁধু তো ঈশ্বর, শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর, রাধাও ঈশ্বর। সভায় সবাই চোখ বুজে বসে আছে, কারু কারু চোখ দিয়ে জল পড়ছে—কেন? ওরা কি ঈশ্বরকে বুঝতে পারছে? বাজে কথা, আমি তো জানি ‘এলিট’ হলে কি হবে, একেক জন কি মিথ্যাবাদী আর স্বার্থপর! আমার যতদূর ধারণা মিথ্যেবাদীদের সঙ্গে ঈশ্বরের যোগাযোগ নেই। আর মীলু? ওর কি দৌড় আমার জানা আছে। ঈশ্বর আমারও ধারে কাছে নেই, ওরও না। আমি চোখ বুজলাম—গানটা কিন্তু খবু সুন্দর গাইছেন। ভদ্রলোকের গলায় কি দরদ! দরদ’ কথাটা ভালো, ঠিক মানেটা বোঝায়— আমার কিন্তু ওর মুখের দিকে দেখবার ইচ্ছে নেই—আমিও চোখ বুজে আছি—কি চমৎকার গলা, সত্যিই “বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী” ঐ সুরের আলোয় আমার ভিতরটা উজ্জ্বল, আমি দেখতে পাচ্ছি অন্য একটা দেশ, নিচু একটা বারান্দার ছাতের এক পাশে উঠে গেছে নীলমণি লতা, তাতে গুচ্ছ গুচ্ছ নীল ফুল, ওর ইংরেজী নাম উইস্টেরিয়া—আর বারান্দার টেবিলের উপর ঝুঁকে একজন লিখছেন তার সাদা কোকড়া চুলের উপর ভোরের আলো পড়েছে—তিনি লিখছেন আর গুনগুন করে গান গাইছেন, সে গানটা অন্য, কিন্তু দুটো গান আমার মনের মধ্যে মিশে যাচ্ছে—“তখন অনলে অনিলে জলে, মধু প্রবাহিনী চলে, বলে মধুরং মধুরং।”
দেখ তো, কেন এদিনটা ভুলেছিলাম। আমার পক্ষে একজন মানুষ ছাড়া এমন শান্তির উৎস, প্রাণের আরাম আর কেউ নেই—থাকতে পারেনা, হওয়া উচিত নয়। আমার ভিতরটা কাঁপছে, মনে হচ্ছে নিজের কাছে যেন সত্যভঙ্গ করছি! কি সে সত্য? আমি জানি না, জানি না।
মির্চার কাণ্ড দেখেছ! অভদ্র, অভদ্র। ওর ঘরের সামনে দিয়ে ‘ম’ বাবু চলে গেল তবুও বেরিয়ে এল না—আমিও ওর ঘরে যাব না। আজ এ-প্রতিজ্ঞাটা রাখব, রাখবই রাখব। তাতে ওর সঙ্গে যদি একেবারে বরাবরের মতো কথা বন্ধ হয়ে যায় তাও ভালো। আমি অন্যমনস্ক হয়ে মাধবীলতা থেকে একটা বড় গুচ্ছ ছিড়ৈ নিয়ে উপরে যাব বলে এগিয়ে গেলাম। ওর ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে পর্দার ফাক দিয়ে দেখি তিনি নিবিষ্ট মনে বই পড়ছেন—কে সামনে দিয়ে এল বা গেল দেখতেই পাচ্ছেন না! আমি পর্দাটা ফাক করে ফুলটা ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছি—পিছন থেকে ওর ডাক শুনতে পেলাম—“অমৃতা! অমৃতা!”
“মা…মা…মা…” ডাকটা যেন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে এল। মহাসিন্ধু নয়, মহাজগৎ থেকে, সামনে তাকিয়ে দেখি আমার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতটা টেলিফোনের উপর—টেলিফোন বাজছে—“মা তুমি টেলিফোনটা তুলছ না কেন?” বহু কষ্টে টেলিফোনটা তুললাম—আমার হাত অসাড়, আমি অস্থির, একই সঙ্গে একই মুহূর্তে এত দূরত্ব পার হওয়া যায়? আমি তো এখানে ছিলাম না, কখনই নয়।
এটা স্মৃতি নয়। আমার শরীর এইখানে চেয়ারে নিশ্চয় পড়েছিল কিন্তু আমি মহাকালে অনুপ্রবিষ্ট, যার সামনেও নেই পিছনেও নেই। যেখানে নাহি রাত্রি, নাহি দিন, না হয় সকাল’। এই শরীর ও মনের বিচ্ছেদ, এই একই সঙ্গে দুই সময়ে, অর্থাৎ আমরা যা দুই সময় বলে দেখতে অভ্যস্ত, সে-রকম দুই সময়ে উপস্থিতি নিশ্চয় শরীরকে আঘাত করে। তাই আমি অবসন্ন। আমার ছেলের বয়স ত্রিশ বছর, সে একজন বয়স্ক মানুষ, ছেলেমানুষ নয়, সে কি ভাবছে কি জানি কিন্তু ও ওর বাবার মতো, না বললে কিছুই জিজ্ঞাসা করবে না। আস্তে আস্তে ও ঘর থেকে চলে গেল। আমি ওর অপসৃয়মান মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি! কে গেল, কোথায় গেল, এর পরে কি, বুঝতে পারছি না। লেখা এসে টেলিফোনটা তুলে নিল আমার হাত থেকে–ওপারে কেউ ছিল—তাকে বলল, “মা তো শুয়ে পড়েছেন, তার নম্বরটা নিল। এখন আমি সব বুঝতে পারছি—ঐ লোটার সঙ্গে কথা বলার দরকার, কিন্তু ভালোই হয়েছে। কি কথা বলব, যদি ভুল হয়। লেখা বললে, “মা আপনি শুয়ে পড়বেন চলুন। আমি আপনাকে বলছি, আপনি কারুর সঙ্গে কথা বলুন।”