বই হাতে করে আমি উপর থেকে নেমে আসছি মির্চা আমার পথের মাঝখানে ধরল—“তুমি নাকি কাল একটা দার্শনিক কবিতা লিখেছ?”
“হ্যাঁ”—আমার গতকালের কবিতাটি নিয়ে বাবা খুব উচ্ছ্বসিত। ওর মধ্যে একটা লাইন আছে—“কালের যবে হারিয়ে যাবে মুহূর্ত নিমেষ”, এ-লাইনটা বাবার খুব ভালো লেগেছে, এর মধ্যে একটা বিরাট তত্ত্ব সম্বন্ধে প্রশ্ন আছে—প্রশ্নটাই হচ্ছে তত্ত্ব। আমার বয়স যখন চৌদ্দ অর্থাৎ দুবছর আগে, পুরীর সমুদ্রের তীরে বসে আছি সন্ধ্যেবেলা, আমার হঠাৎ মনে হল এটা সকাল—একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল, সেটা আমি কবিতায় লিখেছিলাম-“লহ মোরে, লহ মোরে, মোরে চল লয়ে, আমার এ স্বপ্নস্রোতে যেথা গেল বয়ে। সে দেশটা কি রকম?–‘আশাহীন ভাষাহীন শেষ যেথা সব, পান্থহীন পথ পরে নাহি কলরব। জন্মহীন মৃত্যুহীন নাহি রবে কাল, নাহি রাত্রি নাহি দিন না হয় সকাল! বাবা বলেন ‘কাল’ সম্বন্ধে রু’র অনুসন্ধানী চিন্তা রীতিমত শাস্ত্রমুখী। কাল কি? বাবার এই উচ্ছ্বাসে আমি খুব গর্বিত! কিন্তু যখন বাবা আমাকে নির্দেশ দেন, তুমি এই রকম লিখে আন, তখন আমার ভালো লাগে না। কবিতার স্বাভাবিক গতি বন্ধ হয়ে যায়—একটা ডানা মেলা পাখি ডানা ভঁজ করে পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে। ভোগপাত্র’ কবিতাটি লিখে তাই আমি খুশী নই।
মির্চা মুচকি হেসে বললে, “তুমি কি দার্শনিক কবিতা লিখবে এতটুকু মেয়ে!”
“আমি মোটেই এতটুকু নই…তাছাড়া আমি তো দার্শনিক।”
“তুমি দার্শনিক?”
“নিশ্চয়ই। যে দেখে বা দেখতে চায় সেই দার্শনিক! আমি তো দেখি, দেখতে চাই।”
“আচ্ছা চল, তোমার কবিতা শোনাবে।”
আমি ওর ঘরে ঢুকলাম। আমি কয়েকদিন হল ওর ঘরে ঢুকছি, কেউ আমাকে বলেনি যে ওর ঘরে ঢোকা ঠিক নয়, তবু পায়ে একটু বাধা আসে। এটা কি? আমি বুঝতে পারি
এই ঈষৎ বাধা আর সংকোচটা কি। আমি স্বচ্ছন্দ নই তবু খুব স্বচ্ছন্দ ভাব দেখিয়ে বসলাম বড় বেতের চৌকিটাতে। মাঝখানে টেবিল তার ওপাশে হেলান দিয়ে ও ওর বিছানায় বসেছে।
“বোঝাও তোমার দার্শনিক কবিতা।”
“না না, আমি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলি শোনো–নতুন তার যে বইটা বেরিয়েছে ওটা তো উনি আমাকে উৎসর্গ করেছেন, সেই কবিতাটি শোন!”
“সে কি? তোমাকে উৎসর্গ করেছেন!”
“অত চমকে উঠলে কেন? পারেন না কি?”
আমি মনে মনে হাসছি, ও বিশ্বাস করেছে, সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছে, ওকে ঠকাব। পরে কাকার কাছে জানতে পারে জানুক–
“তুমি কি শুনেছ মোর বাণী,
হৃদয়ে নিয়েছে তারে টানি,
জানি না তোমার নাম, তোমারেই সঁপিলাম
আমার ধ্যানের ধনখানি।”
থেমে থেমে অনুবাদ করলাম, অনুবাদ যে কি পদার্থ হল, বোঝা শক্ত নয়। ও ভূকুটি করে রইল। কথাটার ভিতরের অর্থ বোঝবার চেষ্টা করছে। আমি উঠে পড়লাম।
ও বললে, “জানি না তোমার নাম লিখলেন কেন?” ও বুঝতে পেরেছে আমি ধোকা দিয়েছি।
“ঐটাই তো গোপনীয়।”
এই রকম কথাবার্তা মির্চা ইউক্লিডকে বিভ্রান্ত করে, একে ভাষার বাধা তো আছেই দুপক্ষেই-তাছাড়া ভাবের বাধাও। আমরা ঠিক কি ভাবি, ও বোঝে না। সেই না-বোঝার অন্ধকারে ও হাতড়ে বেড়ায়, ওর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, ওর গলার স্বর কাঁপে—‘ধরা দেবে
অধরা ছায়া…রচি গেল প্রাণে মোহিনী মায়া’—এর মধ্যেও মোহিনী মায়া নেমে আসছে কি? কি জানি!
“ঐ মালতী লতা দোলে-পিয়াল তরুর কোলে—” বাড়ির ভিতর থেকে বাইরে যেতে গেলে মির্চার ঘরের সামনের একটা সরু গলি দিয়ে যেতে হয়—ঐ গলির পূর্ব দিকে উঠোন। ঐ উঠোনের থেকে সিঁড়ি দিয়ে গলিতে উঠতে হয় আর খাবার ঘরেও। মির্চার ঘরের ঠিক উপরে আমার শোবার ঘর। বাইরের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণের দিকে নিচেও একটা বারান্দা আছে, উপরেও একটা। নিচের বারান্দার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা মালতী নয়, মাধবীলতা নিচ থেকে উপর পর্যন্ত উঠে গেছে। সেটা বারমাস ফুলে ভরে থাকে, সাদা লাল রঙের মঞ্জরী, আমি ঐ লতাকে দোলাই। ওর ঘরের সামনের গলিটা পেরিয়ে বারান্দার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে ঐ লতাটার আশ্রয়ে এসে পঁড়ালে আমি জানি একটু পরে মির্চা উঠে আসবে, পর্দার ফাক দিয়ে আমাকে আসতে ও দেখেছে। আমি যে ওর জন্য অপেক্ষা করে আছি, সেটা আমি স্পষ্ট করে জানি না, কারণ জানতে চাই না—তবু আমি উৎকর্ণও কেন আসছে না, দেখতে পায় নি কি? কি করা তাহলে, এখানে একটা গান গুনগুন করব, না, কবিতা? কী অন্যায়! কী অন্যায়! এমন তো হওয়া ভালো নয়–যা ভালো নয় তা কখনো করব না, আমি দার্শনিক হব। দার্শনিক যে সত্যাশ্রয়ী, সত্যসন্ধানী। সে কখনো লুকোচুরি করে না, তাই নয় কি? আমি লতাটা ধরে আছি—আমার ভিতরটা মৃদু মৃদু কাঁপছে আশায় ও আশঙ্কায়। এমন সময় রাস্তা থেকে সিঁড়ি দিয়ে খদ্দরের পাঞ্জাবী গায়ে, চটির বিশ্রী শব্দ করে ‘ম’বাবু উঠে এলেন। ‘ম’বাবু আমার এক নিকট আত্মীয়ার দেবর। আমি জানি ওর মনের ইচ্ছাটা কি—ওর সঙ্গে আমি কথা বলি, কারণ ও তো আমাদের একরকম আত্মীয়ই।
“এই যে নমস্কার”
“নমস্কার।”
“আমি সামনের মাসে ইংল্যাণ্ড যাচ্ছি।”
“ভালোই তো।”
“কি জানি কতদিন লাগবে ব্যারিস্টারী পাশ করতে।”
“মন দিয়ে পড়লে বেশিদিন তো লাগবার কথা নয়!”
“মন কি আর দিতে পারব?”
এই সেরেছে! এইবার শুরু হবে স্তবগান। এই সব প্যানপ্যানে খোসামুদে ছেলেগুলোকে দুচক্ষে দেখতে পারি না। এ-রকম বেশ কয়েকটি আছে। মীলু আর আমি খুব হাসি এদের নিয়ে। কিন্তু আজ আমার ভয় করছে। মির্চা যদি বেরিয়ে এসে একে দেখে তাহলে ভূকুটি করবে। মুখ অন্ধকার হবে। ও কি ভেবে নেবে কে জানে!