অবশ্য যখনই দেশ থেকে আত্মীয়স্বজন তাদের পোটলাপুটলি নিয়ে উপস্থিত হতো তখনই আমার ঘর ছেড়ে দিতে হতো, কারণ বাড়ির মধ্যে বাড়তি ঘর ঐ একটাই। তারা দেওয়ালে হাতের ছাপ লাগিয়ে, পর্দায় হাত মুছে, টেবিলে জলের দাগ করে, গ্রহণের স্নানপুণ্যে তৃপ্ত হয়ে যখন চলে যেত তখন আবার আমাকে নূতন করে কাজে লাগতে হতো। মার এ সবে কিছু এসে যায় না। বাহ্যবস্তুর দিকে তিনি তাকান না, মানুষই তার কাছে মূল্যবান। মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ঘর সাজাতে হবে এটা তাঁর একেবারেই মনে আসে না।
কিন্তু আমার আসে যায়–আমি সাজানো গোছানো বাড়িতে বসে কবিতা পড়তে এবং লিখতে ভালোবাসি। আর ভালো লাগে কাকার কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প শুনতে। যে যুদ্ধটা আমাদের চারপাশে চলেছে অথচ আমাদের গায়ে আঁচ লাগছে না। কাকা আমার বাবার জ্যাঠতুতো ভাই, ওদের বাড়িতেই একটু আধটু এদিকে ঝোক আছে। কাকার বড়দাদা জেলে আছেন সেটা আমার খুব গর্বের বিষয়। আমি সহপাঠীদের তার গল্প করি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে এসব নেই, অর্থাৎ বাবা এসবের আমল দেন না। আজকে যখন পিছন দিকে তাকিয়ে ভাবি তখন বেশ মনে পড়ে বেশির ভাগ উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্ত ললাকেরা সে সময়ে স্বাধীনতার সম্ভাবনার কথা ভাবতেই পারতেন না। একটা কথা প্রায়ই শুনতাম—-“এই করে এরা ইংরেজ তাড়াবে। তাহলেই হয়েছে!” কি করে তাড়াবে সে সম্বন্ধে অবশ্য তাদের কোনো পরিকল্পনা শুনি নি। যাহোক অল্পবয়সীদের মনে এই সব দুঃসাহসিক ঘটনার বৃত্তান্ত মোহ সৃষ্টি করছিল—ডাণ্ডি মার্চ ও দপ্তরে ঢুকে সাহেব নিধনের নানা ঘটনাবলীর উত্তাপ পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়িয়ে আমাদের মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেত। একটা কাজ আমরা করতে শুরু করেছিলাম, সম্পূর্ণভাবে বিলাতি দ্রব্য বর্জন।
তাই আমার মুখে ওকথাটা নেহাৎ বেমানান ছিল না—“বাড়িতে আবার একজন ইংরেজ কেন?” যদিও কিন্তু আমার আপত্তির আসল কারণ ছিল পাছে এর জন্যও আমার ঘরটি ছাড়তে হয়।
বাবা আমায় নিশ্চিন্ত করলেন, “একতলার সামনের ঘরে ও থাকতে পারবে, ঘরটাকে পার্টিশন করে দিলে সামনের দিকে লোকজন এসে বসতে পারে বা তোর কাকা থাকতে পারে আর ভিতরের দিকে ইউক্লিড থাকবে।”
সেই দিন সন্ধ্যেবেলা ‘ন্যাশনালিজম’ প্রবন্ধটা দিলেন বাবা, বললেন—“এ বইটা বড়। ইংরেজ হলেই কি সে শত্রু? এমন দিন একদিন আসবে যেদিন প্যাট্রিয়টিজম একটা অপরাধ বলে গণ্য হবে।” সেদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত আমি বইটা নাড়াচাড়া করলাম, ভালো করে কিছুই বুঝলাম না। বাবা সব সময় আমাকে এ রকম নাগালের বাইরের বই দিতেন। আমিও না বুঝেই পড়তে ভালোবাসতাম, এই বোঝা না-বোঝার আলোছায়াময় জগৎটা আমার সব সময় ভালো লাগতো। যেন বুঝতে পারছি অথচ পারছি না, অপার রহস্যময় ঘোমটা পরা এই বিশ্বের অধরা ছায়াই তখন আমার কবিতার প্রেরণা ছিল।
দু-তিন দিনের মধ্যেই সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে গেল, পার্টিশন করেও ঘরটা খবু ছোট নয়, একটা ছোট খাট, টেবিল, চেয়ার, একটা বড় বেতের সোফা, একটা পিয়ানো ও টুল আর মাঝখানে একটা গোল টেবিলের পাশে দাড় করানো ল্যাম্প—গৃহসজ্জা মন্দ কি? পর্দাও টানিয়েছি একটা গলির দিকের দরজায়। এই ঘরটা আমার ঘরের ঠিক নিচে।
সকালবেলা খাবার টেবিলে মির্চা ইউক্লিডের সঙ্গে বাবা নানা বিষয়ে গল্প করতেন, ও কি পড়বে বলতেন। একদিন বাবা বললেন, “তোমরা দুজনে আমার কাছে শকুন্তলা পড়, ‘হিতোপদেশ থেকে সংস্কৃত শিখে লাভ নেই। একটা উপভোগ্য বই হলে ভালো লাগবে।” পরের দিন থেকে আমাদের একসঙ্গে পড়া শুরু হল। মাদুর পেতে মাটিতে বসে সাহেবের সঙ্গে সংস্কৃত পড়া দেখতে সেকালের মানুষদের কেমন লাগত কে জানে! আমি দেখেছি বাবার বাঙালী ছাত্রদের চোখে ঈর্ষামিশ্রিত বিস্ময়, আমি দেখেছি বর্ষীয়সী মাতৃস্থানীয়দের মুখে চোখে সন্দেহ ও আপত্তি আর সমবয়সীদের চোখে কৌতুক। বাবার কিন্তু ভূক্ষেপ ছিল না। মা ও বাবা দুজনেই খবু সহজভাবে ওর উপস্থিতি মেনে নিয়েছিলেন। সে ক্রমে ক্রমে বাড়ির একজন হয়ে যাচ্ছিল।
বাবার কাছে পড়বার সময় আমি ইচ্ছে করেই মাদুরে বসতাম। বাবা বসতেন আমাদের দুজনের মাঝখানে একটা সোফায়। আমি বুঝতাম মাদুরে বসতে মির্চার খবু ভালো লাগছে, একে নূতনত্ব তারপর আমাদের সঙ্গে একাত্ম হবার ইচ্ছা। ও প্রত্যেকটা জিনসি দেখে, খুঁটিয়ে দেখে। আমাদের সব কিছু জানতে চায় আর প্রত্যেকটা ব্যাপারে একটা অর্থ খুঁজে বের করে।
মা বলতেন, “ইউক্লিড খুব ভালো ছেলে, ভদ্র শান্ত বিনীত। তুমি আমায় মা বলো না কেন মির্চা, মিসেস সেন বলল কেন? মা বলবে।”
তারপর থেকে সে মা বলতো। কিন্তু সে আমায় বলেছিল ওদের দেশে এত অল্পবয়সী মেয়েদের কেউ মা বলে না, তারা রাগ করে। আমার মার বয়স তখন কতই বা, বত্রিশ কি তেত্রিশ হবে। কিন্তু লালপেড়ে শাড়ি, কপালে সিঁদুর আর পায়ে আলতা-পরা পরমাসুন্দরী আমাদের মা কেবলই মাতৃমূর্তি, তার বয়সের কথা কে ভাবে! কি জানি, ওদের দেশটা তো ভারি অদ্ভুত, মেয়েদের মা বললে রাগ করে! সেজন্য বয়সের হিসাবের দরকার কি!
সকালবেলা খাবার টেবিল থেকে সকলে উঠে চলে যেত। আমরা বসে বসে গল্প করতাম। তারপর আর একটু উঠে লাইব্রেরীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে ঘণ্টা দুই কেটে যেত প্রায়ই, কেউ লক্ষ্যই করত না। তিনটে ঘর জুড়ে বাবার সাত-আট হাজার বইয়ের লাইব্রেরী—ঐখানেই আমাদের গল্প চলত। সিঁড়ি দিয়ে বাবা নেমে গেলেন, কিন্তু কিছুই বললেন না, এ রকম কত দিন হয়েছে। এমন কি, আজ্ঞা দিয়ে সময় নষ্ট করছ কেন—তাও নয়। যদি মীলুর সঙ্গে কিম্বা গোপালের সঙ্গে গল্প করতাম তাহলে ঠিকই বকুনি খেতাম। কিন্তু মির্চা ইউক্লিডের সঙ্গে নিশ্চয় শাস্ত্র আলোচনা করছি, পরস্পরের উন্নতি হচ্ছে!