- বইয়ের নামঃ ন হন্যতে
- লেখকের নামঃ মৈত্রেয়ী দেবী
- প্রকাশনাঃ জয় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.১ আজ আমার জন্মদিনের উৎসবে
ন হন্যতে
অজো নিত্যঃ শ্বাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।
এই আত্মা জন্মরহিত শ্বাশত ও পুরাতন
শরীরকে হনন করিলেও ইনি নিহত হন না।
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
উপন্যাসের কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নেই, সে তার নিজের কথা নিজেই বলে। তবু আমাকে একটু কৈফিয়ৎ দিতে হচ্ছে। এ বইতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এমন অনেকের নাম উল্লেখ করেছি যারা একদিন জীবিত ছিলেন। এই কাহিনী গড়ে তোলবার জন্য তাদের প্রকৃত নাম উল্লেখের হয়ত তেমন সার্থকতা নেই। শুধু আমি একটি যুগের ছবি আঁকতে চাইছিলাম, যে যুগ এইসব যুগপুরুষ ও অসামান্যা নারীদের উপস্থিতিতে উদ্ভাসিত হয়েছিল। কোনো কাল্পনিক নাম ব্যবহার করে সেই যুগটি আমার কাছে সত্য হচ্ছিল না।
১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে বইটা লেখা হয়েছে, মাত্র দু’মাস আগে পাণ্ডুলিপি ছাপতে দিয়েছি। খুব শখ হয়েছিল পূজার আগে বইটি প্রকাশ হবে। প্রকাশক মশাই আমায় বলেছিলেন এত দ্রুত কাজ ভাল হয় না। কিন্তু আমার অতি আগ্রহবশত আমিই তাড়া করে দু’মাসের মধ্যে বাইশ ফর্মা বইটা ছাপিয়ে ফেললাম—ফলে দু-চারটি মুদ্রণ প্রমাদ রয়ে গেল, যার জন্য প্রকাশক দায়ী নন, দায়ী আমি।
মৈত্রেয়ী দেবী
২রা অক্টোবর, ১৯৭৪
উৎসর্গ
আমার মা
স্বর্গীয়া হিমানীমাধুরী দাসগুপ্তাকে
—১৫ই ভাদ্র, ১৩৮১
১.০১
১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭২
আজ আমার জন্মদিনের উৎসবে তোমরা এসেছিলে পার্বতী ও গৌতমী। তোমরাই উৎসব করেছিলে কিন্তু তোমরা জানতে না, তখনই—ঠিক তখনই, যখন এ ঘরে গান হচ্ছিল, গল্প হচ্ছিল, আমি হাসছিলাম, তখন আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছিলাম। সময়ের প্রবাহ আমার মনের মধ্যে উত্তাল, আমাকে তা ছুঁয়েছিল, আমি চলেছিলাম, চলেছিলাম ভবিষ্যতে নয় অতীতে।
এখন মধ্যরাত্রি পার হয়ে গেছে, হয়তো দুটো বাজে—আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি—এখান থেকে পূর্ণ আকাশ দেখা যায় না, আধখানা সপ্তর্ষি অনন্ত প্রশ্নের মতো আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। প্রশ্ন, প্রশ্ন, প্রশ্ন, আজ এই প্রশ্ন কত যুগ পার হয়ে আবার কেন মনে এল? কেন আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটল যার কোনো প্রয়োজন ছিল না? আবার দেখছি এর আরম্ভও নেই, শেষও নেই।
আকাশের তারাগুলি উজ্জ্বল, কত মানুষের কত যন্ত্রণার সাক্ষী ওরা। আমার সমস্ত মন ঐ আকাশটা টানছে—আমি যেন এখানে নেই, এখানে নেই অথচ আমি তো এখানেই। এখান থেকে কি কোথাও যেতে পারি—এই তো আমার পরিচিত সংসার। শোবার ঘরে আমার স্বামী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। কী নিঃসংশয় আমার সম্বন্ধে, আমাকে উনি ভালোমতো চেনেন না, অথচ কী গভীর ভালোবাসেন, কী বিশ্বাস আমার উপরে! আমিই ওর সব। ওঁর পৃথিবীটা ঘুরছে আমাকে কেন্দ্র করেই, কিন্তু উনি যে আমার সব নয় একথা নিশ্চয়ই উনি কোনো একরকম করে জানেন, তবু তাতে ওর কোনো ক্ষোভ নেই। ক্ষোভ নেই আমারও। আমার জীবন নানাদিক থেকে কানায় কানায় পূর্ণ। সংসারকে যা দেবার ছিল, মনে হয়েছিল তা দিতে পেরেছি, ভালোবাসার যে মহিমা, মনে হয়েছিল তাও জানি, শ্রদ্ধা ও পূজার সঙ্গে মিশে তার অলৌকিক ঊর্ধ্বগামী নিবেদন আমার গুরুর প্রতি, আমাকে কৃতার্থ করেছে। তবু কাল থেকে আমার জীবনের আস্বাদ কি করে এমন বদলে গেল? কী দারুণ অতৃপ্তি, এক ধূ ধূ সাহারার বালির আঁচলের মতো আমার শস্যশ্যামল সুন্দর পৃথিবীর উপর বিছিয়ে গেল! আমি জানি ওর নিচে সব আছে, ঠিক যেমনটি ছিল তেমনি। এখনও ওর অবচেতনে আমি তেমনি সত্য—আর উপরে মা বাবার কোলের কাছে ঘুমিয়ে আছে আমার নাতি, কাল সকালে সে যখন নেমে আসবে, তখন তার নরম ছোট্ট হাত আমাকে তেমনি করে জড়িয়ে ধরবে—আমার পৃথিবী তেমনি আছে কোমল সজীব সবুজ। তবু এর উপর গলিত লাভা গড়িয়ে আসে কেন, আমার মুখে যে গরম বাতাসের তাপ লাগে। না, না, লাভা নয়, গলিত স্বর্ণও হতে পারে—এ তো ফিরিয়ে দেবার নয়, এতে যে আনন্দ আছে, এর যে মূল্য আছে। আমি জানি, এ ছাই হয়ে যাবে না, কারণ, ‘ছাই হয়ে গিয়ে, তবু বাকি যাহা রহিবে’ এ সেই অবশিষ্ট।
তবু আজ দুদিন থেকে কী কষ্ট, কী ভয়ানক কষ্ট পাচ্ছি আমি। কি রকম কষ্ট? ‘রম্যাণি বীক্ষ্য মধুরাংশ্চ নিশম্য শব্দান্’ যে রকম মন ব্যাকুল হয়, জননান্তর সৌহৃদানি মনে পড়ে—‘পযুৎসুকী ভবতি যৎ সুখিতোহপি জন্তুঃ’ সেই রকম কি? তাও তো নয়, এ তো জন্মান্তরের কথা নয়—এ তো এই সে দিনের কথা, মাত্র বেয়াল্লিশ বছর আগের কথা। মাত্র বেয়াল্লিশ বছর আমি পার হয়ে ফিরে গেছি—মানুষের কাছে এ অনেক সময়, কিন্তু অনন্তের কাছে?
সময়ের তত অবস্থান নেই, তার সামনেই বা কি, পিছনেই বা কি, পাশেই বা কি? তার উদয় অস্ত কোথায়—শুধু আমার সম্বন্ধে অনাদি অনন্ত মহাকাল খণ্ডিত—শুধু আমাকে প্রকাশের জন্য সে সীমাবদ্ধ, কিন্তু আজ হঠাৎ বেয়াল্লিশ বছরের গণ্ডী সে তুলে নিয়েছে—আমি মহাকালে অনুপ্রবিষ্ট—আমার সামনে পিছনে নেই—আমি স্থির ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছি এই ১৯৭২-এ পা রেখেও ১৯৩০ সালে।
ঘটনাটা ঘটল কি করে, ঘটল কোন তারিখে?
১৯৭২ সালে ১লা সেপ্টেম্বর সকালে। আগের দিন আমার ছেলেবেলার বন্ধু গোপাল আমাকে ফোন করে বললে, “অমৃতা, তোমার ইউক্লিডকে মনে আছে?”