আমি লেকটার নাম দিয়েছি আমজাদ লেক। আমজাদ স্যারকে তোর মনে আছে না? স্কুলের অঙ্ক স্যার। আমাকে খুবই আদর করতেন। ক্লাসে ঢুকে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলতেন। একটা কথা এখনো কানে ভাসে। ক্লাসে এসে বললেন–যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের অঙ্ক হলো নকল অঙ্ক। আসল অঙ্ক অন্যখানে। সেই অঙ্ক ঠিকমতো করবি। আমি বললাম, স্যার, আসল অঙ্কটা কী?
স্যার বললেন, তুই একজনের জন্যে ভালো কিছু করলি, কিছু যোগ হলো। মন্দ করলি বিয়োগ হয়ে গেল। আবার খুব ভালো কিছু করলি হয়ে গেল গুণ… মৃত্যুর সময় যদি দেখা যায় ফলাফল শূন্য তাহলে বড়ই আফসোস। শূন্য ফলাফল হবে পশু-পাখির। মানুষকে শূন্য করলে চলবে না। মানুষ তো পশু না।
এসএসসি পরীক্ষার ফিস-এর টাকা জোগাড় হলো না বলে আমি লজ্জায় দুঃখে বাড়ি চলে গেলাম। এক ভোরবেলায় স্যার বাড়িতে এসে উপস্থিত। আমাকে বললেন, তোর ফিস-এর টাকা জোগাড় হয় নাই বলে তুই পালিয়ে বাড়িতে চলে এসেছিস? আমাকে বলবি না? তোর শাস্তি হচ্ছে, আমি তোকে কানে ধরে নিয়ে যাব। স্যার তাই করলেন। গয়নার নৌকায় আমরা যাচ্ছি, স্যার আমার কানে ধরে আছেন। লোকজন জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কী? স্যার গম্ভীর গলায় বলেন, শাস্তি দিচ্ছি। আমার ছাত্র। অতি দুষ্ট।
মতিন, তুই নদ্দিউ নতিম সাহেবকে বল না, আমার স্যারকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে। কবিতাটা আমি শ্বেতপাথরে লিখে আমজাদ লেকের একপাশে বাঁধিয়ে দেব।
তুই ভালো থাকিস। আমার শরীরটা ভালো না। ম্যালেরিয়া হয়েছে। পাহাড়ি ম্যালেরিয়া খুব খারাপ জিনিস।
ইতি
কঠিন গাধা
পুনশ্চ : তোর লেখা নদ্দিউ নতিম সাহেবের আত্মজীবনী ইংরেজিতে অনুবাদ করছি। তোর এই লেখা একটি মহৎ সাহিত্যকর্ম হয়েছে সে-জন্যে না। রাতে আমার তেমন কিছু করার থাকে না। তবে অনুবাদ করে আরাম পাচ্ছি। লেখার শিরোনাম দিয়েছি। Autobiography of a Fictitious Poet. নামটার মধ্যে নীরোদ সি চৌধুরী গন্ধ আছে (Autobiography of an unknown Indian, পড়েছিস না?)। গন্ধ থাকুক। শিরোনাম আমার পছন্দ হয়েছে।
কমল তার খেলনা সাজানো শেষ করেছে
বৃহস্পতিবার।
সন্ধ্যা সাতটা।
কমল তার খেলনা সাজানো শেষ করেছে। সে বসে আছে মাথা নিচু করে। তাকে খুবই অসুস্থ মনে হচ্ছে। বুধবার সকাল থেকে সে খাওয়া বন্ধ করেছে। তার ঘরের টেবিলে কয়েক রকমের স্যুপ, ফলের রস সাজানো আছে। যদি সে নিজের ইচ্ছায় কিছু খায়। সে পানি ছাড়া কিছুই খায় নি। তবে স্যুপের বাটির ঢাকনা তুলে দেখেছে তাকে কী দেয়া হয়েছে।
সালেহ ইমরান ছেলের ঘরে আছেন। ত্রিশ মিনিট সময় পার হয়েছে, এখনো দুজনের ভেতর কথাবার্তা শুরু হয় নি। সালেহ ইমরান নিজে কথা শুরু করতে চাচ্ছেন না। তিনি অপেক্ষা করছেন।
কমল প্রথম কথা শুরু করল। ক্লান্ত গলায় বলল, I am hungry.
সালেই ইমরান বললেন, তোমাকে খাবার দেয়া হয়েছে। খাও। এই খাবারগুলি পছন্দ না হলে বলো, অন্য খাবার আনিয়ে দিচ্ছি।
খাব না।
ক্ষিধে লাগলে খেতে হয়, এটা হলো নিয়ম। তুমিই আমাকে বলেছ, নিয়ম গড-এর তৈরি করা। আবার তুমিই নিয়ম ভাঙ্গছ।
সরি।
কার কাছে সরি? আমার কাছে?
কমল শান্তগলায় বলল, না। গড-এর কাছে।
তুমি তাহলে কিছু খাবে না?
না।
সালেহ ইমরান বললেন, আমি যদি বলি তোমাকে মতিনের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেব, আমি যদি প্রমিজ করি, তাহলে কি খাবে?
কখন দেখা করাবে?
আগামীকাল সকালবেলা। মতিন জানিয়েছে, সে এ বাড়িতে আসবে না। কাজেই তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব। ঠিক আছে?
হ্যাঁ ঠিক আছে।
তাহলে খাওয়া শুরু কর। Start with fruit juice.
আমি কাল সকালে খাব।
মতিনের সঙ্গে দেখা হবার পর খাবে, তাই তো?
হুঁ।
এর অর্থ হলো, তুমি আমার প্রমিজ বিশ্বাস করছ না। যে প্রমিজ বিশ্বাস করে, তার সঙ্গে প্রমিজ করা ঠিক না। আমি আমার প্রমিজ উঠিয়ে নিলাম।
তুমি উনার সঙ্গে আমার দেখা করাবে না?
দেখা করাব, কিন্তু প্রমিজ করছি না।
কমল টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। স্যুপের বাটির ঢাকনা তুলে এক চামচ স্যুপ মুখে দিল। সালেহ ইমরান বললেন, তোমার অন্য কিছু খেতে ইচ্ছা করলে বলো, আমি আনিয়ে দিচ্ছি।
কমল জবাব দিল না। সে অতি দ্রুত খাচ্ছে।
সালেহ ইমরান বললেন, স্যুপটা কি ভালো?
হ্যাঁ।
মতিনের সঙ্গে দেখা করা তোমার এত জরুরি কেন?
আমি তাকে একটা secret বলব। I have a secret.
আমাকে বলো।
না, শুধু তাকে বলব।
শুধু তাকে কেন?
সে আমার secret বুঝবে।
তোমার কী করে ধারণা হলো সে তোমার secret বুঝবে?
সে আমার মতো একজন।
তার মানে?
সে আমার মতো একজন।
ব্যাখ্যা কর।
সে আমার মতো একজন।
সালেহ ইমরান উঠে দাঁড়ালেন। কমল কথার পুনরাবৃত্তি শুরু করেছে। একে বলে Autistic childs repeatative mood. সে এখন একই কথা বলে যাবে।
ছেলে খাওয়া শুরু করেছে, এই খবরটা তিনি মুনাকে দিলেন। মুনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাঁচলাম! আমি ঠিক করেছিলাম ডাক্তারকে দিয়ে স্যালাইন দেবার ব্যবস্থা করব। তুমি অসাধ্য সাধন কীভাবে করলে? তোমার magical words কী ছিল? আমাকে শিখিয়ে দিও।
সালেহ ইমরান জবাব দিলেন না। মুলা বলল, কমল আমার চেয়ে তোমার প্রতি বেশি অ্যাটাচড।
হতে পারে।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, সে আমাকে পছন্দ করে না!
অটিজমের শিশুরা কী পছন্দ করে বা করে না এটা বোঝা কঠিন। তারা তাদের পছন্দ অপছন্দ গোপন রাখে।