মুহিব তার দুলাভাই ইস্ট এশিয়াটিক লিমিটেড-এর জেনারেল ম্যানেজার শফিকুর রহমান সাহেবের ঘরের দরজা ফাঁক করে মাথা ঢুকাল।
শফিকুর রহমান বললেন, অপেক্ষা কর। আমি তোমাকে ডাকব। বলেই তিনি হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন। সাতটা পাঁচ বাজে। মুহিবকে সাতটায় আসতে বলেছিলেন। সে পাঁচ মিনিট দেরি করে এসেছে।
শফিকুর রহমান সাহেবের এই অফিস ঘরটি বেশ জমকালো। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট। বিশাল আকৃতির সেক্রেটেরিয়েট টেবিলে তিনটা টেলিফোন। একটা টেলিফোনের রঙ লাল। মনে হয় কোন মিনিস্টারের ঘর। এয়ার কুলার আছে। এই শীতেও এয়ার কুলার চালু করা। বিজ বিজ শব্দ হচ্ছে। মাথার উপর খুব আসে- ফ্যান ঘুরছে। শফিকুর রহমান মাঝে মাঝেই রাত ন‘টা-দশটা পর্যন্ত অফিস ঘরে থাকেন।
তিনি মানুষটা ছোটখাট তবে তাঁকে দেখলেই মনে হয় ঈশ্বর এ-জাতীয় মানুষদের একজিকিউটিভ বস বানানোর জন্যে বিশেষ করে তৈরি করেছেন। তাঁদের গলার স্বর এয়ার কুলারের হাওয়ার মতই শীতল। মেজাজও শীতল, তবে সেই শীতল মেজাজের সামনে এসে দাঁড়ালে বুকের রক্তও শীতল হয়ে যায়।
ঠিক সাতটা কুড়ি মিনিটের সময় শফিকুর রহমান বেল টিপলেন। মুহিব দরজা খুলে ঢুকল। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, তোমাকে ডাকিনি, তুমি বস। যথাসময়ে ডাকব। বেয়ারাকে ডেকেছি চা দেবার জন্যে।
‘একটা কাজ ছিল দুলাভাই।‘
‘আমিও তোমাকে কাজেই ডেকেছি। অকাজে ডাকিনি। অপেক্ষা কর।‘
মুহিব ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়েটিং রুমে বসল।
শফিকুর রহমান তাঁকে কফি দেয়ার নির্দেশ দিয়ে টেলিফোন নিয়ে বসলেন। বিদেশের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগের জন্যে এই সময়টাই উত্তম। কিছু জরুরী ট্রানজেকশন টেলিফোনের মাধ্যমেই হবে। এল সি সংক্রান্ত কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে।
রাত আটটায় মুহিব আবার উঁকি দিল। ক্ষীণ গলায় ডাকল, দুলাভাই।
শফিকুর রহমান ফাইল দেখছিলেন। ফাইল থেকে চোখ তুললেন না। মুহিব বলল, আমার খুব জরুরী একটা কাজ ছিল।
শফিকুর রহমান শীতল গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে বলেই তোমাকে আসতে বলেছি। গসিপ করার জন্যে ডাকি নি। তারপরেও তুমি যদি মনে কর তোমার কাজ অসম্ভব জরুরী তাহলে চলে যেতে পার। তোমাকে বেঁধে রাখা হয়নি।
তিনি টেলিফোন তুলে ডায়াল করা শুরু করলেন। মুহিব ফিরে গেল আগের জায়গায়। তার মুখে থু থু জমতে শুরু করেছে, অসম্ভব রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে পুরো অফিসটা পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দিতে। তার সামনেই এসট্রে তবু সে ইচ্ছে করে কার্পেটে সিগারেটের ছাই ফেলছে।
অফিস এ্যাটেণ্ডেন্ট রফিক মিয়ার অবস্থাও তার মত। সাহেব অফিসে আছেন বলে সেও যেতে পারছে না। শুকনো মুখে হাঁটাহাঁটি করছে। কিছু করার নেই বলেই বোধহয় মুহিবকে এসে জিজ্ঞেস করল, এই বৎসর শীত কেমন বুঝতেছেন স্যার? মুহিব কোন কথা বলল না যদিও তার বলতে ইচ্ছে করছে – কাছে আস রফিক মিয়া, তোমার গালে একটা চড় দেই। চড় খেলে বুঝবে শীত কত প্রকার ও কি কি?
মুহিবের ডাক পড়ল রাত দশটায়। শফিকুর রহমান হাই তুলতে তুলতে বললেন, সরি, অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম। তোমাকে কি কফি দেয়া হয়েছে?
‘জ্বি।‘
‘দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোস।‘
মুহিব বসল। মনে মনে বলল, আপনাকে আমি কোন কালেই পছন্দ করি নি। ভবিষ্যতে কখনো করব, সেই সম্ভাবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। আপনি অতি কুৎসিত একটি প্রাণী। মাকড়শা দেখলে মানুষের যেমন গা ঘিন ঘিন করে – আপনাকে দেখলেও আমার অবিকল সেই রকম গা ঘিন ঘিন করে। এখন আপনাকে দেখাচ্ছে একটা মাকড়শার মত। মেয়ে মাকড়শা। যে পেটে ডিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
‘মুহিব।‘
‘জ্বি।‘
‘তোমাকে চিটাগাৎ যেতে হবে।‘
মুহিবের গা দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। বুক ধক ধক করতে লাগল। মনে হচ্ছে মাকড়শাটা এখন বলবে – আজ রাতেই যেতে হবে। তুর্ণা নিশীথায়।
মুহিব চাপা গলায় বলল, কখন যেতে হবে?
‘দি আর্লিয়ার, দি বেটার। ভোড়ের ট্রেনে যেতে পার। কিংবা দুপুরের দিকে যেতে পার। দুপুরে অফিসের একটা গাড়ি চিটাগাং যাবে। যেটা তুমি প্রেফার কর। তোমার জন্যে চাকরির ব্যাবস্থা করা হয়েছে। কি চাকরি বেতন কত সব চিটাগাং গেলেই জানবে। টেলিফোনে কথা বলে রেখেছি। আজ দুপুরেই কনফার্ম করা হয়েছে। ছয় সাত হাজার টাকা বেতন হবার কথা। তারচে‘ বেশিও হতে পারে। সবচে‘ যেটা ভাল সেটা হচ্ছে – কোয়ার্টার আছে। যতদূর শুনেছি ভালো কোয়ার্টার। বিদেশে ট্রেনিং-এর সুযোগ পাবে। সব সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে অল্প সময়ে ভালো উনড়বতি করবে।‘
মুহিবের হৃৎপিণ্ড এমন লাফাচ্ছে যে মনে হচ্ছে গলা দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসবে। গলার ফুটো ছোট বলে বেরুতে পারছে না। এটা স্বপড়ব দৃশ্য নয়তো? চেয়ারে বসে সে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে স্বপড়ব দৃশ্য খুব বাস-ব হয়। দুলাভাই তার দিকে তাকিয়ে আছেন। স্বপড়ব দৃশ্য হলেও এই মানুষটাকে ধন্যবাদ সূচক কিছু বলা উচিত। মুহিব ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, ‘থ্যাংকস দুলাভাই।‘
‘আমাকে থ্যাংকস দেবার দরকার নেই। তুমি আমাকে পছন্দ কর না তা আমি জানি। আমিও যে তোমাকে পছন্দ করি তাও না। যাই হোক, কাজকর্ম ঠিকমত করবে। রেসপনসিবিলিটি নামক ব্যাপারটি আ্তস্থ করার চেষ্টা করবে। ঠিক আছে এখন তাহলে যাও।‘
মানুষটাকে এখন আর মাকড়শার মত লাগছে না – বরং সুন্দর লাগছে। সুন্দর। ঘর থেকে বেরুনোর সময় দরজায় ধাক্কা খেয়ে কপালের একটা অংশ ফুলে গেল। ব্যথা লাগছে। এটা তাহলে স্বপড়ব নয়। স্বপ্নে শারিরীক ব্যথা বোধ থাকে না।