নাতাশা!
উঁ।
আচ্ছা, তুই কি টেলিফোনের শব্দ শুনেছিস?
না তো!
আমি শুনলাম টেলিফোন বাজছে।
ঘুমের মধ্যে শুনেছ।
তাই হবে, কিন্তু এত স্পষ্ট শুনলাম।
মাঝে মাঝে স্বপ্ন খুব স্পষ্ট হয়। আমি আজকাল প্রায়ই একটা খুব স্পষ্ট স্বপ্ন দেখি।
দিলশাদ আগ্রহের সঙ্গে বলল, কী দেখিস?
নাতাশা শব্দ করে হাসল। দিলশাদ হাসি শুনেই বুঝল এই মেয়ে আর কিছু বলবে না। এই প্রশ্ন আবার করলে সে আবারো হাসবে। দিলশাদ মশারির ভেতর ঢুকে গেল। নিজের ঘরে এখন আর তার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। নাতাশার পাশে শুয়ে পড়লেই হবে। বালিশ নেই। বালিশ আনতে নিজের ঘরে যেতে ইচ্ছা করছে না।
নাতাশা!
উ।
তোর সঙ্গে ঘুমুলে তুই কি রাগ করবি?
নাতাশা হাসল। মিষ্টি হাসি। হাসতে হাসতে বলল, মা, তোমার ঘুম আসছে না, তাই না?
ঠিক ধরেছিস।
এবং তুমি একটু ভয় পেয়েছ।
ভয় পাব কেন?
টেলিফোনের শব্দ শুনে ভয় পেয়েছ।
আমি এত সহজে ভয় পাই না।
আজ একটু পেয়েছ।
আচ্ছা যা, একটু পেয়েছি।
দিলশাদ পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। নাতাশা যে বলেছে মশা নেই তা ঠিক না। এই তো একটা মশা রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল হয়ে আছে। খুঁজলে নিশ্চয়ই আরো পাওয়া যাবে। নাতাশা বলল, তোমার বালিশ লাগবে না?
না।
নাতাশার মাথা ধরেছে। চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা শুরু হলে দুটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। হয় কিছুক্ষণের মধ্যে প্রচণ্ড ঘুম পায়, নয়তো ব্যথা দেখতে দেখতে অসহনীয় হয়ে ওঠে। তখন ইচ্ছা করে প্রচণ্ড শব্দে দেয়ালে মাথা ঠুকে মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে। যেন মাথাটা ফাটলেই ব্যথাটা বের হয়ে যাবে। আজ মাথার চাপা ব্যথাটা কোন দিকে যাবে নাতাশা বুঝতে পারছে না। আতঙ্কে তার শরীরের ভেতরটা কাঁপছে। এই কাপন বাইরের কারো বোঝার উপায় নেই।
নাতাশা!
কী মা?
তুই কি তোর বাবাকে তোর অসুখের কথা কিছু লিখেছিস?
না।
না লেখাই ভালো, শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করবে। বিদেশে যাবার সব ঠিকঠাক হলে আমিই জানাব।
আচ্ছা।
গল্প শুনবি?
শুনব।
নাতাশা মার কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে শুয়েছে। দিলশাদ মেয়ের গা ঘেসে এলো। একটা হাত রাখল মেয়ের গায়ের উপর। হালকা করে রাখল যেন চাপ না পড়ে।
ভূতের গল্প শুনবি?
হুঁ।
ভূতের গল্প শুনে আবার ভয় পাবি না তো?
ভয় পাবার জন্যেই তো ভূতের গল্প শোনা। হাসার জন্যে তো কেউ ভূতের গল্প শুনে না।
তাও তো কথা। শোন তাহলে, সত্যিকার ভূতের গল্প। এক বর্ণ মিথ্যা না। আমার মার মামার বাড়ি হচ্ছে সান্দিকোনা বলে একটা জায়গায়। তারা এককালে বিরাট জমিদার ছিলেন। খুব রমরমা ছিল। তাদের বসতবাড়ির নাম ছিল শতদুয়ারি। বাড়িটার দরজা ছিল একশটা। এইজন্যে শতদুয়ারি নাম। প্রকাণ্ড সব দরজা। যেমন মজবুত তেমন ভারি। দরজার কজায় প্রতি সোমবারে ঘি দেওয়া হতো যেন কাঁচ ক্যাচ শব্দ না হয়। সপ্তাহে ঘিয়ের বরাদ্দ ছিল একসের এক ছটাক…।
তুমি দেখেছ সেই বাড়ি?
হ্যাঁ। সেই গল্পই তো বলছি।
এখনো ঘি দেয়?
এখন ঘি দেবে কোত্থেকে? খাওয়ারই পয়সা জুটে না আর ঘি! গল্পটা শোন। শতদুয়ারি বাড়ির একটা দুয়ার সবসময় বন্ধ থাকত। খোলা নিষেধ ছিল। আমার নানাজানের বাবা নিষেধ করে গিয়েছিলেন। শুধু যে মুখে নিষেধ করে গিয়েছিলেন তাই না– দরজার গায়ে খোদাই করে লিখে গিয়েছিলেন। সংস্কৃত মেশানো অদ্ভুত বাংলা অদ্য দ্বাত্রিংশ শ্রাবণঃ ঐশ্য নির্দেশং ক্ষুধিতং…।
তোমার মুখস্থ মা?
হ্যাঁ। ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম। আমি আর বড় আপা। তখন মুখস্থ করেছি।
তোমার বয়স তখন কত?
ঠিক খেয়াল নেই। তবে কত আর হবে? সাত-আট হবে।
কোন ক্লাসে পড়তে?
তোর সঙ্গে গল্প করা ভারি মুশকিল। এত প্রশ্নের জবাব দিয়ে কি আর গল্প করা যায়?
কোন ক্লাসে পড়তে মনে নেই?
না।
আচ্ছা আর প্রশ্ন করব না। তুমি বলো।
দিলশাদ খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প শুরু করল।
নাতাশা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। তার শরীর ঝিম ঝিম করছে। বড় ধরনের কোনো আনন্দময় ঘটনার আগে আগে শরীর যেমন ঝিম ঝিম করে সেরকম। নাতাশার এই আনন্দের কারণ তার মা’র গল্প নয়। আনন্দের কারণ হচ্ছে তার মাথাব্যথাটা ঘুমের দিকে যাচ্ছে। এক্ষুনি সে ঘুমিয়ে পড়বে। মা’র গল্প এখন খুব অস্পষ্টভাবে তার কানে যাচ্ছে। মা যেন ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছেন। তার গলার স্বর অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে। নাতাশার ঘুম আসছে গাঢ় ঘুম, শান্তিময় ঘুম।
সেদিন কী হলো নাতাশা শোন। ঠিক করা হলো বন্ধ দরজাটা খোলা হবে। তালার চাবি তো অনেক আগে থেকেই নেই। মিস্ত্রি আনা হয়েছে তালা খোলার জন্যে। সে সন্ধ্যা থেকেই তালা খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তালা খুলছে না… নাতাশা, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি?….
নাতাশা জবাব দিল না। দিলশাদ মেয়ের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল। ঘুমিয়ে পড়েছে। দিলশাদ মেয়ের কপালে হাত রাখল। কপাল ভেজা। সে ঘামছে। এমন ঘামা ঘেমেছে, মনে হচ্ছে গোসল সেরে উঠল।
গল্পটা শেষ করতে না পেরে দিলশাদের খারাপ লাগছে। আজ আর ঘুম আসবে না। তার বিশ্রী স্বভাব হয়েছে, রাতে ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসে না। সারারাত জেগে থাকতে হয়। তখন বড় নিঃসঙ্গ লাগে। দিলশাদ সাবধানে মেয়ের পাশ থেকে উঠে এলো। অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে পুবদিকের বারান্দার দরজা খুলল। খুব সাবধানে খুলল। মেয়ের ঘুম যেন না ভাঙে। বিছানা থেকে নেমে আসার পর মনে হলো আরে, মশাগুলি তো মারা হলো না। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। দিলশাদ বারান্দার দিকে পা বাড়াল।