তাহলে ঘুমের মধ্যে টেলিফোনের পরিষ্কার আওয়াজ সে শুনল কীভাবে? শুধু যে ঘুমের মধ্যে শুনেছে তা না। ঘুম ভাঙার পরেও শুনেছে টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। আশ্চর্য তো! তাহলে কি কলিংবেলের আওয়াজ? এ বাসায় কলিংবেল আছে, তার শব্দও টেলিফোন রিং-এর কাছাকাছি। তবে গত দুদিন ধরে সেই কলিংবেল নষ্ট। ফ্ল্যাট বাড়ির কেয়ারটেকার ত্রিশ টাকা নিয়ে গেছে কলিংবেল ঠিক করার জন্যে, এখনো ঠিক হয় নি।
দিলশাদ বিছানা থেকে নামল। বাতি জ্বালাল না। বেশিরভাগ মানুষ রাতে ঘুম ভাঙলে প্রথম যে কাজটি করে তা হচ্ছে বাতি জ্বালানো। হুড়মুড় করে ছুটে যায় সুইচ বোর্ডের দিকে। যেন এই মুহূর্তে সুইচ না টিপলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে। দিলশাদের ব্যাপারটা অন্যরকম। সে রাতে ঘুম থেকে উঠে কখনোই বাতি জ্বালায় না। পানির পিপাসা পেলে অন্ধকারেই খাবার টেবিলের দিকে যায়। খাবার টেবিলে পিরিচে ঢাকা জগ থাকে, গ্লাস থাকে। দিলশাদের অন্ধকারে চলাচল করতে অসুবিধা হয় না। তাছাড়া রাতে এই ফ্ল্যাট কখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয় না। ফ্ল্যাটের বারান্দায় চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাতি সারারাত জ্বলে। বড় রাস্তার পাশে ফ্ল্যাট। রাস্তার হলুদ সোডিয়াম লাইটের আলোও ঘরে ঢোকে।
সাজ্জাদের ধারণা, পুরোপুরি অন্ধকার দেখতে হলে জঙ্গলে যেতে হবে। সত্যিকার অন্ধকার শুধু জঙ্গলেই দেখা যায়। দিলশাদ ঠিক করে রেখেছে নাতাশার চিকিৎসার জন্যে বাইরে যাবার আগে দুদিনের জন্যে হলেও সাজ্জাদের সেই বিখ্যাত জঙ্গল দেখে আসবে। তার নিজের জন্যে নয়, জঙ্গল দেখা বা সত্যিকারের অন্ধকার দেখার শখ তার নেই। নাতাশার জন্যে যেতে হবে। নাতাশা তার বাবার জঙ্গল দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সেই অপেক্ষার ব্যাপারটা সে কিছুতেই বুঝতে দিচ্ছে না। এই মেয়ের সবকিছুই গোপন। নিজ থেকে সে কখনোই বলবে না তার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তার শারীরিক সুবিধা-অসুবিধার কথা জানার কোনো উপায় নেই। দিলশাদের ধারণা, এখন নাতাশার চোখের সমস্যা হচ্ছে। বই পড়ার সময় বই চোখের খুব কাছে নিয়ে আসছে। বেশিক্ষণ পড়ছেও না। মনে হয় পড়তেও কষ্ট হচ্ছে। আগে মাঝে মাঝে দেখা যেত খাটের পাশের টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে সে তার খাতায় রাত জেগে লেখালেখি করছে। এখন তাও করে না।
দিলশাদ মেয়ের ঘরে ঢুকল। নাতাশা হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। খাটের একপাশ দেয়ালের সঙ্গে লাগানো, অন্যপাশে দুটি চেয়ার দেয়া। এই ঘরে জিরো পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। জিরো পাওয়ারের আলো চাঁদের আলোর কাছাকাছি। শুধু চাঁদের আলোয় রহস্য আছে, এই আলোয় রহস্য নেই।
নাতাশা ঘুমুচ্ছে। তার গায়ে পাতলা একটা চাঁদর। কোলবালিশের উপর তার রোগা একটা হাত। কোলবালিশ নাতাশার পছন্দ না, তবু রোজ রাতে দিলশাদ কোলবালিশটা এনে বিছানায় দিয়ে যায়। খাটের পাশে চেয়ার দিয়ে দেয়াল তোলাও নাতাশার অপছন্দ। সে আহত গলায় বলে, তুমি চেয়ার দাও কেন মা? তোমার কি ধারণা আমি গড়িয়ে পড়ে যাব? চেয়ার সরিয়ে নাও তো, আমার বন্দি বন্দি লাগে। নাতাশার খুব অপছন্দের এই কাজটিও দিলশাদ করে। অনেক অপ্রিয় কাজ মাদের করতে হয়।
নাতাশার ঘরে পা দিয়েই দিলশাদের মনে হলো নাতাশা ঘুমুচ্ছে না, জেগে আছে। এরকম মনে হবার যদিও কোনো কারণ নেই। ঐ তো দেখা যাচ্ছে নাতাশার চোখ বন্ধ। ঘুমন্ত মানুষের মতো ধীর লয়ে তার নিঃশ্বাস পড়ছে।
দিলশাদ নরম গলায় ডাকল, নাতাশা! এই বুড়ি!
নাতাশা জবাব দিল না। অথচ দিলশাদ মোটামুটি নিশ্চিত ছিল নাতাশা চোখ মেলে বলবে, কী?
দিলশাদ খাবার ঘরের দিকে গেল। তার পানির পিপাসা হচ্ছে। খাবার টেবিলে পানির জগ-গ্লাস নেই। ফুলির মা আজকাল কাজকর্ম ঠিকমতো করছে না। রুটিন কাজে প্রায়ই ভুল করছে। তিনজন মানুষের সংসারে এরকম হবে কেন? দিলশাদ বাতি জ্বালাল। ফ্রিজের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করল। পানি ঠাণ্ডা হয় নি। ফ্রিজে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। গ্যাস ফুরিয়ে গেছে বা অন্য কিছু হয়েছে। পানি ঠাণ্ডা হয় না। ফ্রিজ ঠিক করার সামর্থ্য এখন দিলশাদের নেই। প্রতিটি পয়সা এখন তার কাছে সোনার টুকরোর মতো। তবে ফ্রিজটা ঠিক করতে হবে। নাতাশা ঠাণ্ডা পানি খেতে ভালোবাসে। তৃষ্ণা পেলেই বলবে, মা, ঠাণ্ডা পানি দাও তো।
খাবার ঘরের চেয়ারে দিলশাদ কিছুক্ষণ বসে রইল। বসে থাকতে ভালো লাগছে, তবে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। খুব মশা। এক্ষুনি মশা তাকে হেঁকে ধরবে। দিলশাদ আবার নাতাশার ঘরে ঢুকল। আশ্চর্য, মেয়ে চুপচাপ খাটে বসে আছে। দিলশাদ বলল, ব্যাপার কী রে? নাতাশা লজ্জিত গলায় বলল, কিছু না।
আমি যখন তোকে ডাকলাম তখন তুই কি জেগে ছিলি?
হুঁ।
জবাব দিস নি কেন?
এমনি।
পানি খাবি?
না।
দিলশাদ খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসল। নাতাশার গায়ে কি জ্বর আছে? কিছুদিন হলো রাত করে জ্বর আসছে। বেশ ভালো জ্বর। দিলশাদ বলল, গা গরম নাকি রে মা?
উঁহু।
মেয়ের কথা দিলশাদের বিশ্বাস হলো না। সে মশারির ভেতর হাত ঢুকিয়ে মেয়ের গায়ের তাপ দেখল। জ্বর নেই, গা ঠাণ্ডা। একটু কি বেশি ঠাণ্ডা? শরীর কেমন হিম হয়ে আছে।
মাথার যন্ত্রণা নেই তো মা?
উঁহু।
মশারির ভেতর মশা ঢুকে নি তো?
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। দিলশাদের উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু নাতাশার বোধহয় বিশ্রাম দরকার।