হুঁ।
তুই তোর অসুখ নিয়ে কোনোরকম চিন্তা করবি না।
চিন্তা করছি না তো।
ডাক্তারদের ধারণা, তোর মাথায় ছোট্ট মটরদানার মতো একটা টিউমার হয়েছে। বেনাইন টিউমার। বেনাইন টিউমার কাকে বলে জানিস?
না।
বেনাইন হলো যে টিউমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
ও।
ডাক্তার অপারেশন করে ঐ টিউমার সরিয়ে ফেলবেন। সেই অপারেশনও খুব সহজ অপারেশন। আমাদের দেশে হচ্ছে না, তবে বিদেশে হরদম হচ্ছে। তোর অপারেশন আমি বিদেশে করাব।
এত টাকা কোথায় পাব?
সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। যেভাবেই হোক আমি জোগাড় করব।
কত টাকা লাগবে?
তাও তোর জানার দরকার নেই। তুই শুধু মনে সাহস রাখবি। তোর মনে সাহস আছে তো?
হুঁ, আছে।
সাহস খুব বড় একটা গুণ। এই গুণ পশুদের অনেক বেশি। মানুষের কম। কেন কম বল তো?
মানুষ বুদ্ধিমান, এইজন্যেই মানুষের সাহস কম। বুদ্ধিমানরা সাহসী হয় না।
মা আমার কথায় চমকে গিয়ে আমার দিকে তাকালেন। এরকম কথা তিনি মনে হয় আমার কাছ থেকে আশা করেন নি। মা আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। নরম গলায় ডাকলেন, নাতাশা!
উঁ।
তুই কি তোর বাবাকে অসুখের কথা কিছু লিখেছিস?
না।
তোর কিছু লেখার দরকার নেই। যা লেখার আমিই লিখব।
আচ্ছা।
রিকশায় করে আরো কিছুক্ষণ ঘুরবি?
আজ আমার রিকশায় ঘুরতে ভালো লাগছে না। খুব ক্লান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে রিকশার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ব, তবু বললাম, হুঁ ঘুরব।
তুই আর তোর বাবা রিকশা চড়ায় ওস্তাদ। ঠিক বলি নি?
হুঁ।
তোর ঘুরতে ভালো লাগছে?
লাগছে। রিকশার হুড ফেলে দাও।
না, হুড ফেলা যাবে না। গায়ে রোদ লাগবে।
আমি চোখের পাতা মেলে রাখতে পারছি না। হঠাৎ করে রাজ্যের ঘম আমার চোখে নেমে এসেছে। আমি মার কাছে ঘেঁসে এলাম। তার শরীরের গন্ধ এখন আরো তীব্র হয়েছে। পরিচিত কোনো ফুলের গন্ধের সঙ্গে এই গন্ধের মিল আছে। কী ফুল তা মনে করতে পারছি না। মা বললেন, কী রে, তোর শরীর খারাপ লাগছে নাকি? তুই এরকম করছিস কেন?
আমি জবাব দিলাম না। চেষ্টা করলাম আরো মার কাছে ঘেসে আসতে। সেটা সম্ভব না। কারোরই খুব বেশি কাছাকাছি যাওয়া যায় না। কথাটা কে যেন বলেছিল? বাবা বলেছিল? মনে হয়, বাবা।
এরকম অদ্ভুত আর মজার মজার কথা বাবা ছাড়া কে বলবে? বাবার কথাটা কি সত্যি? যদি সত্যি হয় তাহলে হাজার চেষ্টা করেও বাবা মার খুব কাছে যেতে পারবেন না, আবার মাও বাবার খুব কাছে যেতে পারবেন না।
তবে আমার মনে হয়, কথাটা সত্যি না। ইচ্ছে করলেই মানুষের খুব কাছে যাওয়া যায়। সেই ইচ্ছেটাই কেউ করে না। ‘ আমি বেঁচে থাকলে করতাম। যার সঙ্গে আমার বিয়ে হতো, আমি খুব চেষ্টা করতাম তার কাছাকাছি যেতে। সে খারাপ ধরনের মানুষ হলেও করতাম। সে বাইরে থেকে ঘরে এলে আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুলে তার দিকে তাকিয়ে হাসতাম। মা’র মতো চোখ-মুখ শক্ত করে থাকতাম না। সে ঘরে ঢোকামাত্র আমি তার হাত ধরে বলতাম–আজ সারাদিন কী কী করলে বলো তো। সে হয়তো বিরক্ত গলায় বলত, আহা, কী শুরু করলে! হাত-মুখটা ধুতে দাও। আমি বলতাম, আগে বলতে হবে সারাদিন কী করলে, তারপর তোমাকে ছাড়ব।
আচ্ছা, আমি বোধহয় একটু খারাপ হয়ে গেছি। এখন প্রায়ই বিয়ের কথা ভাবি। এই বয়সে কোনো মেয়ে নিশ্চয়ই বিয়ের কথা ভাবে না। মনে হয় দিন-রাত বিছানায় শুয়ে থাকার জন্যে এটা হয়েছে। কিছু করার নেই, শুয়ে শুয়ে থাকা। বাংলা আপা একবার বলেছিলেন, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের ক্রীড়াভূমি।’ আমার অলস মস্তিষ্ক শয়তানের খেলার মাঠ হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে আবার রাতে বিয়ের স্বপ্ন দেখে ফেললাম। রোগা কালো একটা ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা রোগা এবং কালো হলেও তার চোখ খুব সুন্দর। আর খুব হাসতেও পারে– সারাক্ষণ হাসছে। আমি তাকে বললাম, এই শোন, এত মেয়ে থাকতে তুমি আমাকে বিয়ে করলে কেন? তুমি কি জানো না– আমি বাঁচব না? আমার ব্রেইন টিউমার হয়েছে। মেনিনজিওমা।
ছেলেটা সেই কথা শুনে আরো হাসতে লাগল। তারপর বলল, ঠাট্টা করবে না তো। অসুখ-বিসুখ নিয়ে ঠাট্টা করতে নেই। ঠাট্টা করলে সত্যি সত্যি অসুখ হবে।
আমি বললাম, ঠাট্টা করছি না। তুমি মাকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
এতে সে মজা পেয়ে আরো হাসতে লাগল। আমি তখন রেগে গিয়ে বললাম, খবরদার, হাসবে না।
ছেলেটা তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তাহলে কি আমি কাঁদব? বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তার কান্না দেখে আমার এত খারাপ লাগল যে আমিও কাঁদতে লাগলাম।
তখন মা এসে ধাক্কা দিয়ে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, নাতাশা, কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
আমি আমার সব কথা মাকে বলি– স্বপ্নের কথাটা মাকে বলতে পারলাম না। এমন লজ্জা লাগল।
আচ্ছা, এইজন্যেই কি একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের খুব কাছে যেতে পারে না? লজ্জা, দ্বিধা, ভয় একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে রাখে? খুব ঘনিষ্ঠ দুজন মানুষের মাঝখানেও বোধহয় পর্দা থাকে। কারো পর্দা খুব ভারী, কারোটা আবার হালকা স্বচ্ছ মসলিনের। সব দেখা যায় তারপরেও অনেক কিছুই দেখা যায় না।
টেলিফোনের শব্দে
টেলিফোনের শব্দে দিলশাদ জেগে উঠল। অনেক রাত, ঘর অন্ধকার। মাথার কাছে দেয়ালঘড়ি টিক টিক করছে। বেশ বাতাস। বাতাসে জানালার পর্দা নড়ছে। চারপাশের পৃথিবী পরিচিত, শব্দাবলি পরিচিত। কিন্তু যে টেলিফোনের শব্দ ঘুম ভাঙাল সেই টেলিফোন এলো কোত্থেকে? এ বাসায় টেলিফোন নেই। কখনো ছিল না। সাজ্জাদের যখন দিনকাল ভালো ছিল তখনো না। সাজ্জাদ টেলিফোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করেছিল, লাইন আসে নি। কে জানে এতদিনে হয়তো এসেছে। পুরনো বাড়িতে টেলিফোন মিস্ত্রিরা ঘোরাঘুরি করছে।