আহা, তবু একটা অনুমান কর না।
এক হাজার টাকা।
তোর কি মাথাটা খারাপ নাকি? এক হাজার টাকা তো সাধারণ একটা গ্লাস সেট কিনতেই লাগে। ঐ দিন জার্মানির কাট গ্লাসের একটা সেট কিনলাম, আট পিসের সেট। দাম পড়ল ন হাজার টাকা। তোর দুলাভাই খুব রাগ করছিল। রাগ করলে লাভ হবে? এরকম জিনিস কি সবসময় পাওয়া যায়? হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায়। এইজন্যে সবসময় চোখ-কান খোলা রেখে বাজারে ঘুরতে হয়। ভালো জিনিস কখনো পড়ে থাকে না। কেউ দেখল, ফট করে নিয়ে নিল।
বড় খালার দীর্ঘ গল্প কী যে বিরক্তিকর! একনাগাড়ে এই গল্প শুনলে যে-কেউ ঘুমিয়ে পড়বে। বড়খালা আমার মা হলে গুলশান-বনানী নিউমার্কেটের দোকানগুলির সব জিনিসপত্রের দাম আমার মুখস্থ থাকত। তিনি হয়তো পাঁচশ পাতার একটা খাতা আমাকে বানিয়ে দিতেন। সেই খাতায় আমাকে সব জিনিসপত্রের দাম লিখে রাখতে হতো। কে জানে, তখন হয়তো আমাকেও তার সঙ্গে দোকানে দোকানে ঘুরতে হতো।
মেজোখালা ভয়ঙ্কর কৃপণ বলেই কিছু কেনেন না। শুধু দেখেন। তিনি গল্প রেন অন্য বিষয় নিয়ে। তার গল্প হলো কে কে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সেই গল্প। মেজোখালার ধারণা, তিনি এই পৃথিবীর সবচে’ রূপবতী মেয়ে এবং তাঁর চোখে আছে অসম্ভব আকর্ষণী ক্ষমতা। যে পুরুষ একবার তার চোখের দিকে ভালোমতো তাকাবে সে সারাজীবনের জন্যে আটকা পড়ে যাবে। মেজোখালা খুব বুদ্ধিমতী। কিন্তু এত বুদ্ধিমতী একজন মহিলা এমন বোকার মতো একটা ধারণা নিয়ে বাস করেন কীভাবে কে জানে। তবে মেজোখালা গল্প করেন খুব সুন্দর করে। গলার স্বর নিচু করে, হাত নেড়ে, চোখ বড় বড় করে সুন্দর বর্ণনা। শুনতে খুব ভালো লাগে।
বুঝলি দিলশাদ, কী কাণ্ড হয়েছে শোন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সোহাগ কম্যুনিটি সেন্টারের ঘটনা। চন্দনার বিয়েতে গিয়েছি। চন্দনাকে চিনেছিস তো? ঐ যে ব্রিগেডিয়ার লতিফের মেজো মেয়ে। আমি পরেছি একটা কাঞ্জিভরম শাড়ি, বিসকিট কালারের জমিন, মেজেন্টা পাড়। একদিকে মেজেন্টা, অন্যদিকে সবুজ। খাওয়া-দাওয়ার পর আমি পান নিচ্ছি, হঠাৎ সাফারি পরা এক ভদ্রলোক এসে বললেন, ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি। আপনি কি শুনবেন? আপনার কাছে হাতজোড় করছি। আমি বললাম, বলুন।
এখানে খুব ভিড়। আপনি যদি গেটের কাছে একটু আসেন। জাস্ট ফর এ সেকেন্ড।
এমন করে বলছে না গেলে খারাপ দেখা যায়। আমি গেলাম ভদ্রলোকের সঙ্গে। তারপর যা হলো সে এক ভয়াবহ ব্যাপার। থাক, নাতাশার সামনে বলব না। সে আবার চোখ বড় বড় করে শুনছে। আয় দিলশাদ, অন্যঘরে যাই।
আমার দুই খালারই অনেক টাকা। ঢাকা শহরে তাঁদের দুটা-তিনটা করে বাড়ি আছে। তাঁরা কেউ গাড়ি ছাড়া বের হতে পারেন না। ঈদের বাজার করতে কোলকাতা যান। শুধু আমার মা গরিব। এখন তিনি এনজিও’র কী একটা চাকরি করেন। বড় একটা গাড়ি এসে তাঁকে নিয়ে যায়। অনেক পোজপাজ, কিন্তু বেতন কম। যা বেতন পান তার অনেকটাই চলে যায় বাড়িভাড়ায়, বাকি টাকাগুলি তাকে খুব সাবধানে খরচ করতে হয়। বুয়া কতটুকু চাল সিদ্ধ করবে তা পর্যন্ত মা মেপে দেন। বুয়া নিজে নিজে চাল নিলে বেশি নিয়ে ফেলতে পারে। মাঝে মাঝে মা’র অসময়ে চা খেতে ইচ্ছা করে। তিনি খুশি খুশি গলায় চেঁচিয়ে বলেন, একটু চা কর তো ফুলির মা। তারপরেই সম্ভবত তার মনে হয় এটা বাড়তি খরচ। অসময়ের চায়ে বাড়তি চিনি লাগবে, দুধ লাগবে। হিসেবের চিনি দুধে টান পড়বে। মা হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বিষণ্ণ গলায় বলেন, থাক, লাগবে না। এই সময় আমি একটা কাণ্ড কার। আমি বলি, আমারও খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে মা। বুয়াকে তোমার জন্যে চা করতে বলো। আমি তোমার কাপ থেকে দুচুমুক খাব। আমাকে দুচুমুক খেতে দেয়ার জন্যে বাধ্য হয়ে মাকে চা খেতে হয়। সেই চা তিনি বেশ আয়োজন করে খান। মা’র চা খাওয়া পর্বটা বেশ মজার। অনেকটা পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসেন। চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার আগে খুব সাবধানে ঠোঁট আগিয়ে আনেন। যেন চাটা ভয়ঙ্কর গরম। ঠোঁট লাগানো মাত্র পুড়ে যাবে। কয়েক চুমুক চা খাওয়ার পর মা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। তখন তাকে দেখে মনে হয় তিনি এই জগতে নেই। ভিন্ন কোনো জগতে বাস করছেন। সেই জগতের সঙ্গে এই পৃথিবীর কোনো মিল নেই। তখন যদি দরজার কড়া নড়ে মা শুনতে পান না।
একবার মা এরকম অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। তখন ফুলির মা একটা প্লেট ভেঙে ফেলল। ঝন ঝন শব্দ হলো। মা সেই শব্দও শুনতে পেলেন না। অথচ আমাদের বাসায় কাপ-পিরিচ ভাঙা ভয়াবহ ঘটনা। অন্যমনস্ক অবস্থায় মা কী ভাবেন আমার জানতে ইচ্ছা করে। প্রায়ই ভাবি জিজ্ঞেস করব। তারপর আর জিজ্ঞেস করা হয় না। এখন রিকশায় করে মা’র সঙ্গে ফিরছি। মা ডানহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। তার গা থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। হালকা গন্ধ। যে গন্ধ শুধু মাদের শরীরেই থাকে এবং মাদের সন্তান ছাড়া আর কেউ সেই গন্ধ পায় না। আমি ডাকলাম, মা। মা জবাব দিলেন না। তিনি এখন ডুবে গেছেন তার সেই বিখ্যাত অন্যমনস্কতায়। মা’র তাকানোর ভঙ্গি থেকেই বোঝা যাচ্ছে আমার কোনো কথাই এখন তার কানে ঢুকবে না। রাস্তার গর্তে পড়ে রিকশা বড় একটা ঝাঁকুনি খেল। মা’র অন্যমনস্কতা কেটে গেল। মা ফিসফিস করে বললেন, নাতাশা!