তোমাদের ছেড়ে বাইরে থাকতে হবে।
দয়া করে তাই থাক।
কোনোরকম চিন্তা করবে না, প্রতিমাসে খরচ পাঠাব।
তোমাকে কোনো খরচ পাঠাতে হবে না। দয়া করে তুমি ঢাকায় এসো না। তাহলেই আমি খুশি হব।
তোমার যে চাকরি তাতে তো আর বাড়িভাড়া দিয়ে সংসার চালাতে পারবে না।
সেটা আমি দেখব।
তুমি বরং এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে ভালো কোনো অ্যাপার্টমেন্ট নাও, যেখানে সিকিউরিটি সিস্টেম ভালো। একা একা থাকবে…।
আমাদের নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।
বাবা চলে যাবার দিনও বেশ খারাপ ব্যবহার করলেন। সেলাই মেশিন দিয়ে জানালার পর্দা সেলাই করছিলেন। বাবা স্যুটকেস হাতে নিয়ে বললেন, যাই। মা সেলাই করতে করতে বললেন, আচ্ছা। মা ফিরে তাকালেন না বা উঠে দাঁড়ালেন না। বাবা আবার বললেন, যাচ্ছি তাহলে, কেমন?
মা বললেন, আচ্ছা।
চিঠি দিও। আমি পৌঁছেই ঠিকানা জানিয়ে দেব।
মা জবাব দিলেন না। সেলাই মেশিন চালাতে লাগলেন। ঘরঘর শব্দ হতে লাগল। বাবা বিষণ্ণ মুখে দরজার দিকে যাচ্ছেন। তাকে খুব লজ্জিত মনে হচ্ছিল। আমি তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। তিনি মাথা নিচু করে হাঁটছেন, মনে হচ্ছে আমাকে চিনতেও পারছেন না। রিকশায় ওঠার সময় আমি বললাম, প্রতি সপ্তাহে চিঠি দিও বাবা। তিনি বললেন, হুঁ হুঁ।
সেই রাতেই আমার প্রথম মাথায় যন্ত্রণা হলো। টিভিতে নাচের একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। নজরুলগীতির সঙ্গে নাচ। গানটা খুব সুন্দর, নাচটাও সুন্দর হচ্ছিল। স্টুডিওতে নকল একটা নদী বানিয়েছে। সেই নদীতে চাঁদের আলো পড়ে ঝিলমিল করছে। বোঝা যাচ্ছে নকল, তারপরেও ভালো লাগছে। এই সময় হঠাৎ আমার কাছে সবকিছু ঝাঁপসা লাগতে লাগল। প্রথম ভাবলাম ইলেকট্রিসিটির ভোল্টেজে কিছু হয়েছে। তারপর দেখি ঘরবাড়ি দুলছে। আমি ভয় পেয়ে ডাকলাম, মা মা! মা ছুটে এলেন আর তখনি তীব্র যন্ত্রণায় মাথাটা ফেটে যাবার মতো হলো। আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, হঠাৎ দেখি পড়ে যাচ্ছি। মা এসে আমাকে ধরে ফেললেন। আর তখনি ব্যথা কমে সব স্বাভাবিক হয়ে গেল।
মা ভাবলেন, বাবা চলে গেছেন এইজন্যেই আমার মাথার যন্ত্রণা হয়েছে। আমি কিন্তু পরিষ্কার বুঝলাম বাবার যাওয়া না-যাওয়া না– এই ব্যথা সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমার খুব ভয় ভয় করতে লাগল। রাতে মাকে বললাম, মা, আমি তোমার সঙ্গে ঘুমুব।
অনেক দিন পর মা’র সঙ্গে শুয়েছি। মা আমার গায়ে-মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, বাবা চলে যাবার জন্যে মনটা খুব খারাপ, তাই না?
আমি বললাম, হুঁ।
তুই তোর বাবাকে কি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসিস?
হুঁ।
তাকে কতটা বেশি ভালোবাসিস? সামান্য বেশি না অনেকখানি?
অনেকখানি।
আমাকে তোর ভালো লাগে না?
ভালো লাগে না তা তো বলি নি। ভালো লাগে, তবে বাবার চেয়ে অনেক কম ভালো লাগে।
এই যে তোর বাবা প্রতিরাতে নেশা করে বাসায় ফেরে, নেশার ঘোরে হৈচৈ চিৎকার করে, সংসারের কোনো কিছু দেখে না তারপরেও তাকে ভালো লাগে?
হুঁ।
মা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তাহলে তো স্বীকার করতেই হয় তোর বাবা খুব ভাগ্যবান। এরকম জীবনযাপন করার পরও ছেলেমেয়ের ভালোবাসা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সবার ভাগ্যে এটা হয় না।
আমি বললাম, তোমাকেও আমি খুব ভালোবাসি মা বাবার জন্যে ভালোবাসা একরকম আর তোমার জন্যে ভালোবাসা অন্যরকম।
সেটা কী বুঝিয়ে বল।
বুঝিয়ে বলতে পারব না।
আচ্ছা থাক, বলতে না পারলে বলতে হবে না। ঘুমো।
.
আমার মা খুব গোছানো স্বভাবের মেয়ে। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। এলোমেলো কিছুই তার পছন্দ না। সামান্য একটা শাড়ি যখন ঘরে পরেন তখন এমন গুছিয়ে পরেন, মনে হবে সেজেগুঁজে আছেন– এক্ষুনি কোথাও বেড়াতে বের হবেন। কাউকে যখন কাঁচের গ্লাসে পানি দেবেন সেই গ্লাস ঝকঝক করবে। একবার পানি খাবার পর আবার পানি খেতে ইচ্ছা করবে। মাকে আমার অনেকের চেয়েই আলাদা মনে হয়। মার অন্য দুই বোন– আমার বড় খালা আর মেজোখালার সঙ্গে তার কোনোরকম মিল নেই। অথচ তারা তিনজনই দেখতে একরকম। গলার স্বরও একরকম। বড় খালা ও মেজোখালা দুজনের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যই হলো শপিং সেন্টারে ঘোরাঘুরি করা। বড়খালা সবসময়ই কিছু না কিছু কিনছেন। মেজোখালা দেখে বেড়াচ্ছেন। কিনছেন না, দরদাম করছেন। তাদের সমস্ত কথাবার্তাই কেনাকাটা নিয়ে। বড়খালা হয়তো এলেন, তিনতলা পর্যন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেলেন। তাঁর ভারি শরীর, তিনি অল্পতেই হাঁপিয়ে যান। ঘরে ঢুকেই বলবেন, ও দিলশাদ, ঠাণ্ডা পানি দে। মরে গেলাম রে। তাঁকে পানি দেয়া হলো। গ্লাসের দিকে তাকিয়েই বললেন– গুলশানের একটা দোকানে গ্লাসের একটা সেট দেখলাম। অসাধারণ। সোনালি কাজ করা। খুব হালকা কাজ। ছোট ছোট পাতা। গ্লাসে পানি ভরলে গ্লাসটা দেখা যায় না, পানিও দেখা যায় না। শুধু সোনালি কাজগুলি দেখা যায়।
মা এ জাতীয় কথায় অংশগ্রহণ করেন না। চুপচাপ বসে থাকেন। তার চোখের দৃষ্টিতে আগ্রহ বা অনাগ্রহ কিছুই থাকে না। বড়খালার তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি কথা বলতেই থাকেন।
মেড ইন জাপান, বুঝলি। জাপানিরা এরকম গ্লাস বানাবে ভাবাই যায় না। দুটা সেট ছিল, একটা কিনলাম। দাম কত বল তো? তোর অনুমান দেখি।
আমার অনুমান ভালো না।