আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে মা। এয়ারপোের্ট রওনা হবার আগে বারান্দায় গিয়ে দেখি আমার সবকটা অর্কিডে ফুল ফুটেছে। নীল নীল ফুল বারান্দা আলো হয়ে আছে।
বলিস কী! একবার গিয়ে দেখে আসব।
এটা নিশ্চয়ই খুব ভালো লক্ষণ। তাই না মা?
অবশ্যই ভালো লক্ষণ।
মা, তুমি কি নাতাশার বাবাকে চুপি চুপি একটা কথা বলে আসবে?
কী কথা?
তুমি তাকে বলবে আমি এয়ারপোর্টে ঢুকব না। সে যেন নাতাশাকে আমার কাছে না আনে।
আদা বলে আসছি।
নতুন সাদা ড্রেসটায় নাতাশাকে কী স্মার্ট লাগছে দেখছ মা?
হ্যাঁ, দারুণ সুন্দর লাগছে।
কেমন গট গট করে হাঁটছে দেখছ মা?
হ্যাঁ দেখছি। আজ মনে হয় ওর শরীরটা ভালো।
মা, তুমি আমার হয়ে ওর নাকে একটা চুমু দিয়ে এসো।
আচ্ছা মা। দেব।
.
নাতাশা তার বাবার হাত ধরে ইমিগ্রেশন এরিয়ার ভেতর ঢুকতে যাচ্ছে। তার খুব লজ্জা লজ্জা লাগছে। এত মানুষ এসেছে তাকে বিদায় দিতে। তাদের স্কুল থেকে চারজন আপা এসেছেন। আজ সে যাচ্ছে এই খবরটা তারা কীভাবে পেলেন কে জানে। তাদের ফ্ল্যাট বাড়ি থেকেও প্রায় সবাই এসেছে। ঐ তো তার মা’র অফিসের বস রহমান সাহেব। তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। এত বড় একজন অফিসার গভীর রাতে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছেন।
এমন অনেকে এসেছে যাদের নাতাশা চেনে না। তাঁর বাবার এক ফুফু এসেছেন– অতি বৃদ্ধা। দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে এসেছেন।
নাতাশা সবাইকে এয়ারপোর্টে দেখতে পাচ্ছে শুধু তার মাকে দেখতে পাচ্ছে না। সে একসময় বলল, মা কোথায় বাবা!
সাজ্জাদ বলল, তোমার মা এয়ারপোর্টের বাইরে। তার খুব মাথা ধরেছে। সে ভিড় সহ্য করতে পারছে না। ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। চল আমরা ভেতরে ঢুকে পড়ি।
চল।
দেখ কত মানুষ তোমাকে সি-অফ করতে এসেছে। ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাত নাড়।
নাতাশা হাত নাড়ল। হাত নাড়তে গিয়ে দেখল, ডাক্তার সাহেবও এসেছেন। পিজির নিওরোসার্জন প্রফেসর ওসমান। পায়জামা-পাঞ্জাবিতে ভদ্রলোককে কী সুন্দর লাগছে! উনি হাসিমুখে হাত নাড়ছেন। নাতাশা বলল, বাবা দেখ– পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ঐ ভদ্রলোক আমার ডাক্তার। উনার নাম– ওসমান। উনার চোখ খুব সুন্দর। চশমা দিয়ে চোখ ঢাকা, এইজন্যে তুমি দেখতে পাচ্ছ না।
সাজ্জাদ বলল, তাই বুঝি?
সাজ্জাদের গলার স্বর খুব ভারী শুনাল। পুরুষমানুষ কাঁদে গোপনে। তখন তাদের চোখ দিয়ে পানি বের হয় না। শুধু তাদের গলা ভারী হয়ে যায়। কথা জড়িয়ে যায়।
বাবা!
কী গো মা?
শেষবারের মতো মা’কে একটু দেখতে ইচ্ছে করছে।
সাজ্জাদ বলল, শেষবারের মতো দেখা আবার কী? তুমি ভালো হয়ে ফিরে আসবে। মাকে দেখতে দেখতে তোমার চোখ পচে যাবে।
নাতাশা শান্ত গলায় বলল, ও আচ্ছা।
.
এয়ারপোর্ট থেকে অনেকটা দূরে দিলশাদ তার মাকে নিয়ে ঘাসের উপর বসে আছে। মনোয়ারা পান খাচ্ছেন। জর্দার গন্ধে জায়গাটা ম ম করছে।
দিলশাদ বলল, তোমার হাতে কি ঘড়ি আছে মা–-কটা বাজে?
মনোয়ারা বললেন, ঘড়ি নেই মা। রাত তিনটার মতো বোধহয় বাজে।
এক্ষুনি তাহলে নাতাশাদের প্লেন ছাড়বে। তাই না মা?
হুঁ।
মা, তোমার কি মনে হয় জীবিত অবস্থায় আমার মেয়ে ফেরত আসবে?
অবশ্যই আসবে মা।
সেদিন প্রচুর ফুল নিয়ে এয়ারপোর্টে আসতে হবে।
অবশ্যই ফুল নিয়ে আসতে হবে। ঢাকা শহরে ফুলের দোকানের সব ফুল আমরা কিনে ফেলব।
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা। বুকটা ফেটে যাচ্ছে কী করব বলো তো।
মা, একটু কাঁদতে চেষ্টা কর। কাঁদলে বুক হালকা হবে।
অনেকক্ষণ থেকেই কাঁদতে চেষ্টা করছি, পারছি না।
.
বিকট গর্জন করে ডিসি-১০ আকাশে উঠে গেল। দিলশাদ উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। বিমানটি দেখার চেষ্টা করছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে। ঐ যে। সে উৎফুল্ল গলায় বলল- মা দেখ, দেখ।
আকাশভর্তি ঘন কালো মেঘ। বিজলি চমকাচ্ছে। ক্ষমতাধর মানুষের সৃষ্ট বিশাল যন্ত্রযান মেঘ কেটে উপরে উঠে যাচ্ছে। কত অবলীলাতেই না সে উড়ছে।
দিলশাদের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে মার দিকে হাত বাড়িয়ে শান্ত গলায় বলল, তুমি কুট কুট করে কী সুন্দর পান খাচ্ছ। তোমার মুখ থেকে একটু পান দাও তো মা।