নানিজান, আপনার সব কথার মধ্যে শুধু আল্লাহপাক। সুন্দর একটা ফুল দেখেও আপনি বলেন- আহা রে আল্লাহপাক কী সুন্দর করেই না ফুলটা বানিয়েছে! শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
নানিজান, আপনার মতো আল্লাহ-ভক্ত মানুষ বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আরো অনেক আছে, কিন্তু আপনার মতো এত সুন্দর করে আল্লাহর কথা আর কেউ বলে, তা আমার মনে হয় না। শেষবার যখন আপনি আমাকে দেখতে এলেন, তখন আপনাকে আমি একটা কঠিন প্রশ্ন করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আপনি সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। কিন্তু আপনি হাসিমুখে জবাব দিলেন। আমি বললাম, আচ্ছা নানিজান, আমার এই কঠিন অসুখটা কি আল্লাহ দিয়েছেন? কেন দিলেন? আমি তো কোনো অন্যায় করি নি। কোনো পাপ করি নি। তিনি কেন আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন? আর শাস্তি তো তিনি শুধু আমাকে দিচ্ছেন না, আমার সঙ্গে মা-বাবাকেও শাস্তি দিচ্ছেন এমনকি আপনি শাস্তি পাচ্ছেন। কেন?
আপনি তখন আমার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, কঠিন যে পাপী তাকে শাস্তি দিতেও আল্লাহপাক দ্বিধাবোধ করেন। তিনি নিজে সুন্দর। যা কিছু তিনি সৃষ্টি করেন তাও সুন্দর। রোগব্যাধি অসুন্দর। আমার মনে হয় না– এই রোগ এই ব্যাধি তার তৈরি। তিনি প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন। তাকে আপন মনে চলতে দিয়েছেন। রোগব্যাধি জন্মেছে। তিনি সেখানে হাত দেন নি। সবকিছুকেই তিনি তাঁর মতো চলতে দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট জীবন যখন রোগব্যাধিতে কষ্ট পায় তখন তিনিও কষ্ট পান।
সেই কষ্ট তিনি দূর করেন না কেন?
দূর করবেন না কেন– করেন। সেই জন্যেই তো চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তবে হুট করে তিনি কিছু করেন না। তাতে জগতের নিয়ম ভঙ্গ করা হয়। জগতের আইনকানুনগুলিও তাঁর সৃষ্টি, কিন্তু তিনি তা ভাঙেন না। আইন ভাঙা মানেই অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করা। সৃষ্টিকর্তা তা হতে দিতে পারেন না।
তবে ইচ্ছা করলে তিনি পারেন। তাই না নানিজান?
অবশ্যই পারেন। পারেন বলেই তো আমরা সবসময় তার কাছে প্রার্থনা করি। মানুষ যখন মহাবিপদে পড়ে, যখন চরম দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়, তখন তারা আল্লাহর উপর রাগ করে। তাদের দুঃখকষ্টের জন্যে আল্লাহকে দায়ী করে। মানুষের দুঃখকষ্টের দায়িত্ব মানুষের, আল্লাহ দুঃখকষ্ট সৃষ্টি করেন না। তিনি সুন্দরের সৃষ্টিকর্তা। তিনি সুন্দর সৃষ্টি করেন। বুঝতে পারছিস?
হুঁ।
নানিজান, আপনি তখন আমার চুলে বিলি দিতে দিতে আরো অনেক কথা বলতে লাগলেন। আপনি গভীর বিশ্বাস থেকে কথা বলেন বলেই সহজে সেইসব কথা মনে গেঁথে যায়।
আপনার সব কথা সেদিন আমি মনে গেঁথে নিয়েছি। আমার মনটা হালকা হয়ে গেছে। তখন নানিজান, আপনি আমার কানে কানে অদ্ভুত একটা কথা বললেন, আপনি বললেন…।
কী বললেন তা তো আপনার মনেই আছে, তাই না? মৃত্যু আমার পাশে এসে যখন বসবে তখন আপনার কথাগুলি ভেবে আমি মনে সাহস পাব।
নানিজান, আপনি আমাকে যেভাবে সাহস দিলেন, আমার মা এবং বাবাকেও এইভাবেই সাহস দেবেন। আপনার কাছে এই আমার শেষ অনুরোধ।
ইতি
আপনার নাতু
.
প্রিয় বাবা,
বাবা, তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি সেটা কি তুমি জানো? জানো না, তাই না?
আমিও জানি না। ভালোবাসা যদি তরল পানির মতো কোনো বস্তু হতো তাহলে সেই ভালোবাসায় সমস্ত পৃথিবী তলিয়ে যেত। এমনকি হিমালয় পর্বতও।
বাবা, আমি যখন থাকব না তখন তুমি আমার কথা ভেবে কষ্ট পেও না। তুমি কষ্ট পেলে সেই কষ্ট কোনো না কোনো ভাবে আমার কাছে পৌঁছবে। তখন আমার খুব খারাপ লাগবে।
বাবা, তুমি মাকে সাহস দিও। আদর-ভালোবাসা দিয়ে তুমি মা’র মনের সব কষ্ট দূর করে দিও।
মনে রেখো বাবা, তোমাকে অবশ্যই লাল রঙের একটা গাড়ি কিনে আগের দিনের মতো মা’কে পাশে বসিয়ে হাইওয়ে দিয়ে শো শো করে চালাতে হবে। মনে থাকবে তো বাবা?
তোমার টিয়া পাখি।
.
প্রিয় মা-মণি,
মা, আমি তোমাকে ছেড়ে কখনো যাব না। মৃত্যুর পরেও আমি থাকব তোমার খুব কাছে। তোমার আনন্দ দেখে আমি হাসব আবার তুমি যখন দুঃখ পাবে তখন আমিও খুব দুঃখ পাব। কাজেই মা দুঃখ পেও না। মন খারাপ করো না। বাবা যখন লাল গাড়ি কিনবে তখন তুমি বাবার পাশে হাসতে হাসতে বসবে। বাবা যখন শ শ করে গাড়ি চালাবে তখন তুমি চুল বেঁধে রাখবে না, চুল ছেড়ে দিও। বাতাসে মাথার চুল উড়লে খুব সুন্দর লাগবে দেখতে। সেই সুন্দর দৃশ্য আমি একদিন দেখব ভাবতেই ভালো লাগছে।
আদরের মা-মণি! তোমাকে আমি খুব খুব সুখী করব এরকম একটা ইচ্ছা ছিল। তুমি চেয়েছিলে আমি ডাক্তার হব। আমি ভেবেছিলাম খুব বড় একজন ডাক্তার হব। এমন ডাক্তার যে হাসিমুখে রোগীর ঘরে এসে দাঁড়ালেই রোগ অর্ধেক সেরে যায়।
আমি তা পারলাম না মা। রোগে নিজে কষ্ট করলাম, তোমাকে কষ্ট দিলাম। অসুখের চিকিৎসার জন্যে টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তুমি কত না অপমানের ভেতর দিয়ে গেলে। তোমাকে আমি এই কষ্ট, এই অপমানে ফেলেছি– তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও, মা।
নানিজান আমাকে বলেছেন- মৃত্যুর ঠিক আগে আগে মানুষ আল্লাহপাকের কাছে অন্যের জন্যে যে প্রার্থনা করে আল্লাহপাক তা শুনেন। শুধু তার নিজের জন্যে যে প্রার্থনা করে তা শুনেন না।
আমি ঠিক করে রেখেছি, মৃত্যুর ঠিক আগে আগে আমি আল্লাহকে বলব হে আল্লাহ, তুমি আমার মার মন থেকে আমার সমস্ত স্মৃতি সরিয়ে নিয়ে যেও। কোনোদিন যেন আমার কথা ভেবে মা কষ্ট না পায়। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার সেই প্রার্থনা শুনবেন।