বাবার কথায় অতিথিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবেন। মা’র ভুরু কুঁচকে যাবে। চোখের দৃষ্টি সরু হয়ে যাবে। বাবা অসহায়ের মতো সবার দিকে একবার করে তাকাবেন। অথচ কেউ বুঝবেন না বাবা এই কাণ্ড ইচ্ছে করে ঘটিয়েছেন। তাঁর খিদে পেলে তিনি ফুলির মাকে বলে ডিম ভেজে খেতে পারেন। তিনি তা না করে সবার সামনে মাকে বিব্রত করে একধরনের মজা পাচ্ছেন। এই ব্যাপারগুলো আমি বুঝি, মা বুঝেন না। এইজন্যেই মাকে আমার খুব বুদ্ধিমতী বলে মনে হয় না। বুদ্ধিমতী যে-কোনো মেয়ে এই ব্যাপারটা ধরে ফেলত।
সবাই বলে ছোট পরিবার সুখী পরিবার। রাস্তায় সাইনবোর্ডে লেখা থাকে। চিঠির উপর সিল মারা থাকে ছোট পরিবার যার, সুখের অন্ত নাই তার। আমাদের পরিবার ছোট পরিবার। আমি, বাবা আর মা। না, ভুল বললাম, ফুলির মা আছে। সে আমার জন্মের আগে থেকে এ বাড়িতে আছে। কাজেই সেও তো পরিবারেরই একজন। তাকে নিয়ে আমরা চারজন। আমাদের খুব সুখী হবার কথা। আমরা বোধহয় সুখী না। বাবা-মা’র সম্পর্ক বরফের মতো। তারা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করেন। এমন কঠিন ঝগড়া! কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া তা একটু বলি– আমাদের ফুলির মা’র সিগারেট খাওয়ার বিশ্রী অভ্যাস আছে। বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে সে সিগারেট চুরি করে রাখে। অনেক রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আরাম করে খায়। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে স্মাৎ করে নাক দিয়ে সেই ধোয়া টেনে নেয়। আমি কয়েকবার দেখেছি। একদিন বাবা করলেন কী তাকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে এনে দিয়ে বললেন, চুরি করার দরকার নেই। এই প্যাকেটটা রাখ। শেষ হলে বলবে, আবার এনে দেব। মা এটা শুনে হৈচৈ শুরু করলেন। আর ফুলির মা শুরু করল কান্না। ব্যাপারটা এখানে শেষ হয়ে যেতে পারত, শেষ হলো না। রাত দুটার সময় মা বাবাকে বললেন, তোমার সঙ্গে আমার বাস করা সম্ভব না। তুমি চলে যাও। বাবা বললেন, রাত দু’টার সময় আমি কোথায় যাব?
তুমি যদি না যাও আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে যাব।
ঠিক আছে আমিই যাচ্ছি, তবে আপাতত বসার ঘরের সোফায় শুয়ে থাকছি। ভোর বেলা চা খেয়ে চলে যাব।
তুমি এখনি যাবে।
বাবাকে রাত দুটার সময়েই চলে যেতে হলো। তবে তার জন্যে তাঁকে খুব দুঃখিত বলেও মনে হলো না। এই ঘটনা থেকে মনে হতে পারে মা’র দোষই বেশি। আসলে তা না। বাবা মাকে রাগিয়ে দেবার জন্যে যা যা করা দরকার সবই করেন। খুব গুছিয়ে করেন। মাকে রাগিয়ে তিনি কী আনন্দ পান তিনিই জানেন।
সাপ মা’র খুব অপছন্দের প্রাণী। সাপের নাম শুনলেই তিনি শিউরে ওঠেন। কোনোদিন যদি মা কোনো সাপের ছবি দেখেন তাহলে সেদিন তিনি কিছু খেতে পারেন না। এইসব জেনেশুনেও বাবা একবার সাপুড়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে একটা সাপ কিনে নিয়ে এলেন। ছোট্ট একটা কাঠের বাক্সে সাপটা ভরা। বাক্সের ডালায় সাপের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্যে একটি ফুটো। মা বললেন, বাক্সে কী? বাবা হাই তুলতে তুলতে বললেন, নাথিং। অ্যাবসুলিউটলি নাথিং।
নাথিং মানে কী?
একটা সাপ কিনলাম।
মা চমকে উঠে বললেন, কী কিনলে?
সাপ। সরীসৃপ। আমার অনেক দিনের শখ।
মা আতঙ্কে শিউরে উঠে বললেন, তোমার অনেক দিনের শখ সাপ কেনা?
হুঁ।
তোমার এই শখের কথা তো কোনোদিন শুনি নি।
তুমি সাপ ভয় পাও এইজন্যে বলা হয় নি। এখন যেহেতু সাপ পুষব দেখবে তোমার ভয় কেটে যাবে। এক ঢিলে দুই পাখি। আমার শখ মিটল, তোমার ভয় কাটল।
তুমি এই সাপ পুষবে?
অবশ্যই। সাপ পোষা অত্যন্ত সহজ। খাওয়ার খরচ নেই বললেই হয়। সপ্তাহে একটা ইঁদুর। লোকে যে বলে সাপ দুধ খায়, কলা খায় সবই ফালতু কথা। দুধ চুমুক দিয়ে খেতে ফুসফুস লাগে। সাপের ফুসফুস নেই। কলা খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। সাপ তো আর বাদর না যে কলা খাবে।
সাপ অবশ্যি শেষপর্যন্ত পোষা হয় নি। বাবাকে কাঠের বাক্সসদ্ধ ফেলে দিয়ে আসতে হয়েছে। বাবাও জানতেন ফেলা হবে। পুরো ব্যাপারটা তিনি করেছেন মাকে কিছু যন্ত্রণা দেয়ার জন্যে। যন্ত্রণা দেয়া গেছে এতেই তিনি খুশি। পঞ্চাশ টাকায় সাপ কেনা তার সার্থক। পঞ্চাশ টাকায় এতটা আনন্দ পাবেন তা বোধহয় বাবা নিজেও ভাবেন নি। তার আনন্দিত মুখের ছবি এখনো আমার চোখে ভাসে।
.
বাবা অনেক দিন হলো আমাদের সঙ্গে থাকেন না। থাকেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবনে। কাঠের ব্যবসা করেন। কাঠের ব্যবসা যারা করে তারা ক্রমাগত ধনী হয়, বাবা শুধুই গরিব হন। মা’র ধারণা, ব্যবসা-ট্যাবসা কিছু না। ব্যবসার অজুহাতে জঙ্গলে গিয়ে বসে থাকা, নিরিবিলিতে মদ খাওয়া। মার ধারণা সত্যি হতেও পারে।
নেশা করার কুৎসিত অভ্যাস বাবার আছে। খুব প্রবলভাবেই আছে। যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে গেছে। গালটাল ভেঙে কী বিশ্রী যে তাকে দেখায়! অথচ যৌবনে বাবা কী সুন্দরই না ছিলেন! বিয়ের পর তোলা বাবা ও মা’র একটা বাধানো ছবি মা’র শোবার ঘরে আছে (এখন নেই। মা সেই ছবি সরিয়ে ফেলেছে)। সেই ছবিতে বাবাকে দেখায় রাজপুত্রের মতো। মা অসম্ভব রূপবতী, তারপরেও বাবার পাশে মানায় না। রাজপুত্রের পাশে রাজকন্যার মতো লাগে না। রাজপুত্রের পাশে মন্ত্রিকন্যার মতো লাগে।
মা’র যখন বিয়ে হয় তখন বাবা বিদেশী এক ওষুধ কোম্পানির প্রোডাকশান ম্যানেজার ছিলেন। তাঁর ছিল টকটকে লাল রঙের একটা মরিস মাইনর গাড়ি। গাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি লাল টাই পরতেন। মাকে পাশে বসিয়ে খুব ঘুরতেন। বিয়ের একবছরের মাথায় চাকরি ছেড়ে দিলেন– তাঁর নাকি বোরিং লাগছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নিলেন। সেই চাকরি বছর দুই করার পর তাও তার কাছে বোরিং লাগতে লাগল। প্রাইভেট কলেজে কিছুদিন মাস্টারি করলেন। সেটাও ভালো লাগল না। ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসার শুরুটা খুব ভালো ছিল। ব্যবসা করতে গিয়েই মদ খাওয়ার অভ্যাস হলো। কাজ বাগাবার জন্যে নানান পার্টিতে নাকি যেতে হয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই একটু-আধটু খেতে হয়। জীবনের কোনো কিছুই তার দীর্ঘদিন ভালো লাগে নি, মদ খাওয়া ভালো লেগে গেল। মদ খাওয়াটা ছাড়তে পারলেন না। সংসারে অশান্তির সীমা রইল না। অশান্তি শেষ হলো যেদিন বাবা বললেন, দিলশাদ, কাঠের ব্যবসা করব বলে ঠিক করেছি। বান্দরবন চলে যাব। কাঠ কেটে হাতি দিয়ে নামানো। খুবই লাভের ব্যবসা। মা কঠিন গলায় বললেন, তোমরা যা ইচ্ছা কর। কাঠ হাতি দিয়ে টেনে নামাও বা নিজেই টেনে নামাও আমার কিছু যায় আসে না।