তারপরেও কিছু কিছু মানুষ আছে যারা দুঃখ-কষ্টের সময় পাশে এসে দাঁড়ায়। দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো বড় কোনো অস্ত্র তাদের হাতে থাকে না তাদের থাকে শুধু হৃদয়পূর্ণ ভালোবাসা।
তুমি আমার চরম দুঃখের এবং চরম কষ্টের সময়ে আমার পাশে দাঁড়ালে। যেন আমি নাতাশা নামের কোনো মেয়ে না– আমি তোমার ফুলি।
আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথার সময় তুমি সব কাজ ফেলে ছুটে এসে যখন দুহাতে আমাকে কোলে তুলে নিতে তখন তোমার মুখটা আমার মার মুখের মতো হয়ে যেত। আমার মা’র গা থেকে যেমন গন্ধ বের হয় তোমার গা থেকেও তখন ঠিক সেই রকম গন্ধ বের হতো। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার।
ফুলির মা বুয়া, আমি তোমার কথা মনে রাখব। যে কদিন বাঁচব মনে রাখব। আমার এই মনে রাখা-না-রাখায় কিছু যায় আসে না। কিন্তু এর বেশি তো আমার কিছু করার নেই।
ভালোবাসা ডাবল করে ফেরত দিতে হয়। তোমার ভালোবাসা আমি ডাবল করে ফেরত দিতে পারব না। এত ভালোবাসা আমার নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, পৃথিবীর মানুষ আমার হয়ে তোমাকে তোমার ভালোবাসা ডাবল করে ফেরত দেবে।
মৃত্যুর পর আমি তোমার মেয়েকে খুঁজে বের করব। তাকে বলব তোমার মা একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন। এই পৃথিবী তাঁর মতো ভালো মহিলা খুব কম তৈরি করেছে। ফুলি এই কথা শুনে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।
তাহলে আজ যাই ফুলির মা বুয়া।
যাই কেমন?
ইতি—
তোমার আদরের
টিয়া পাখি নাতাশা।
.
প্রিয় নানিজান,
আসসালামু আলাইকুম।
দেখলেন নানিজান, আপনার কথা আমি ভুলি নি। অনেক দিন আগে আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। আপনি বলেছেন আমাদের ‘নাতু’ এত গুছিয়ে চিঠি লিখে, শুধু একটাই ত্রুটি– চিঠির শুরুতে আসোলামু আলাইকুম লেখে না।
এবার আপনি আর সেটা বলতে পারবেন না। নানিজান, আমার অসুখের পর আপনি শুধু দুবার আমাকে দেখতে এসেছেন। এই দুবারই যে আমার কী ভালো লেগেছিল! আপনি যে কত ভালো তা আপনি নিজে কি জানেন নানিজান? যেই আপনার কাছে আসে তারই মন ভালো হয়ে যায়।
আপনি হাসতে হাসতে গল্প করেন। কুট কুট করে পান খান। সামান্য কথায় হেসে ভেঙে পড়েন। তখন ঠোঁট বেয়ে লাল পানের পিক গড়িয়ে পড়ে। দেখতে কী যে সুন্দর লাগে।
আমরা বইপত্রে সবসময় পড়ি মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। সেই শ্রেষ্ঠ যে আসলে কী তা আপনাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। আমাদের বাংলা রচনা ক্লাসে একবার রচনা লিখতে দেয়া হলো তোমার জীবনের আদর্শ মানব। কেউ লিখল মহাত্মা গান্ধী, কেউ লিখল শেখ মুজিবুর রহমান। একজন লিখল, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, একজন লিখল মাদার তেরেসা। শুধু আমি লিখলাম—- আমার নানিজান।
বাংলা আপা আমার সেই রচনা ক্লাসে সবাইকে পড়ে শুনালেন। তারপর বললেন, নাতাশা, তোমার নানিজান সারাক্ষণ শুধু হাসেন এইজন্যেই কি তিনি তোমার জীবনের আদর্শ মানব?
আমি বললাম, চরম দুঃখেও তিনি হাসেন।
বাংলা আপা বললেন, তোমার রচনা খুব সুন্দর হয়েছে। দশের ভেতর আমি তোমাকে সাড়ে ছয় দিলাম, কিন্তু নাতাশা, একটা কথা মনে রাখবে- আদর্শ মানব তিনিই হবেন যিনি তার কর্ম নিজের এবং নিজের সংসারের বাইরে ছড়িয়ে দেবেন। বিরাট একটা মানবগোষ্ঠী যাতে উপকৃত হবে। তোমার নানিজান কি এমন কিছু করেছেন যাতে বিরাট মানবগোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে?
জি-না।
এইখানেই সমস্যা, বুঝলে নাতাশা। তোমার রচনা পড়ে আমি নিশ্চিত তোমার নানিজান অসাধারণ একজন মহিলা। তাঁকে আমার দেখতেও ইচ্ছা করছে। কিন্তু তিনি তাঁর অসাধারণত্ব বাইরে ছড়িয়ে দিতে পারেন নি। নিজের সংসারের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আটকে রেখেছেন। কাজেই তাকে তুমি আদর্শ মানুষ হিসেবে নিও না।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
বাংলা আপা বললেন, তোমার নানিজানকে বাদ দিয়ে তোমার জীবনে আদর্শ মানব কে এখন বলল দেখি।
আমি অনেক ভাবলাম, তারপরেও মনে হলো– নানিজান। অবশ্যি আপাকে বললাম– বেগম রোকেয়া আপা একটু লজ্জা পেলেন কারণ তাঁর নামও রোকেয়া।
আমি জানি, আপনি আমার চিঠি পড়ে লজ্জা পাচ্ছেন। আপনার প্রশংসা করে কেউ কিছু বললেই আপনি লজ্জা পান। এবং আপনি যখন ভালো কিছু করেন এমনভাবে করেন যে কেউ বুঝতে পারে না ভালো কাজের পেছনের মানুষটা আপনি।
নানাভাই একটা স্কুলে এক লক্ষ টাকা দিয়েছেন। আমার তখনি সন্দেহ হলো এর পেছনে আছেন আপনি। নানাভাই একদিন আমাকে দেখতে এলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এতগুলি টাকা হঠাৎ স্কুলে দিলেন কেন নানাভাই?
তিনি বিরক্ত মুখে বললেন, আরে তোর নানিজান একদিন ভোরবেলা আমাকে বলে সে আমার বাবাকে স্বপ্নে দেখেছে। তিনি বলছেন– বৌমা, দীর্ঘদিন আমি এই স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। আজ স্কুলের ভগ্নদশা দেখে আমার মনটা খারাপ হয়েছে। তুমি স্কুলের সাহায্যের একটা ব্যবস্থা কর।
তখন টাকাটা দিলেন?
আরে না। তোর নানিজানের যা স্বভাব, রোজ কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যান ঘ্যানে জীবন অতিষ্ঠ। টাকাটা দিয়ে ঘ্যানঘ্যানানির হাত থেকে বেঁচেছি।
তখন আমার মনে হলো স্বপ্নের ব্যাপারটাও আপনি বানিয়ে বলেছেন। আপনি কোনো স্বপ্ন-টপ্ন দেখেন নি। আপনার স্কুলে সাহায্য করার ইচ্ছা হয়েছে, তাই মিথ্যা একটা গল্প বলে নানাভাইয়ের হাত থেকে টাকা বের করেছেন।
নানিজান, আমি যখন আমার সন্দেহের কথা আপনাকে বললাম- তখন আপনি হাসতে হাসতে বিছানায় প্রায় গড়িয়ে পড়ে যেতে যেতে বললেন, আল্লাহপাক তোকে এত বুদ্ধি কেন দিল রে নাতু?