আমি বললাম, প্লিজ মা। প্লিজ।
মা বাবার দিকে তাকাতেই বাবা ধাঁধা শুরু করলেন– এক বোবা-কালা গিয়েছে পেরেক কিনতে। দোকানদারকে সে হাতে হাতুড়ির মতো ইশারা করে পেরেকের কথা বলল। দোকানদার পেরেকের বদলে হাতুড়ি এনে দিল। তখন সেই বোবা-কালা একহাতে পেরেক ধরার ভঙ্গি করে অন্যহাতে হাতুড়ি মারার মতো করল। তখন দোকানদার বুঝতে পেরে পেরেক এনে দিল। তার কিছুক্ষণ পর দোকানে এক অন্ধ এসে উপস্থিত। তার দরকার একটা কেঁচি। এখন বলো দেখি ঐ অন্ধ কেঁচির কথাটা কীভাবে দোকানদারকে বুঝাবে?
আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি। মা কী বলেন- শোনার জন্যে ছটফট করছি। মা ডানহাত উপরে তুলে আঙুল দিয়ে কেঁচির মতো কাটার ভঙ্গি করলেন। আমি এবং বাবা দুজনই হো হো করে হেসে ফেললাম। আমি বললাম, মা, ঐ অন্ধ লোক তো মুখেই বলবে– আমার কেঁচি দরকার। সে আঙুল দিয়ে দেখাবে কেন?
মা চমকে উঠে বললেন, আরে তাই তো?
আমি এবং বাবা দুজনই আবারো হেসে উঠলাম। মা নিজেও সেই হাসিতে যোগ দিলেন। আমার এত ভালো লাগল। কত বছর পর তিনজন মিলে হাসছি। আশ্চর্য!
আমাদের হাসি থামার পর মা হ্যান্ডব্যাগ থেকে টিকিট বের করে বাবাকে বললেন, নাতাশার সঙ্গে তুমি আমেরিকা যাচ্ছে। আমি তোমার টিকিট কেটেছি। কাজেই ওর সব কাগজপত্র তোমাকে খুব ভালো করে বুঝে নিতে হবে। বাবা এমনভাবে মার দিকে তাকাচ্ছেন যেন মার কথা তিনি বুঝতে পারছেন না। যেন মা একজন বিদেশিনী। অদ্ভুত কোনো ভাষায় কথা বলছেন। যে ভাষা বাবার জানা নেই। মা বললেন, তুমি কাপড়চোপড় কী নেবে গুছিয়ে নাও। সময় তো বেশি নেই।
বাবা বিড়বিড় করে বললেন, তুমি যাচ্ছ না?
বললাম তো না। একটা কথা ক’বার করে বলব?
না–মানে, মানে…।
মা উঠে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাবা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে আমাকে কিছু না বলেই দ্রুত বের হয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন কে জানে। হয়তো নিজের জিনিসপত্র গোছাতে গেলেন। কিংবা অন্যকিছু। আমি একা একা শুয়ে আছি। আমার ভালো লাগছে না, আবার খারাপও লাগছে না। এটা বেশ অদ্ভুত অবস্থা। আমাদের জীবনটা হয় ভালো লাগায়, নয় খারাপ লাগায় কেটে যায়। ভালোও লাগে না, খারাপও লাগে না এরকম কখনো হয় না। হলেও খুব অল্প সময়ের জন্যে হয়।
আমি আমার খাতাটা হাতে নিলাম। চিঠিগুলি লিখে ফেলা দরকার। কাকে কাকে লিখব? মাকে, বাবাকে, নানিজানকে এবং ফুলির মাকে। ফুলির মা চিঠি পড়তে পারবে না। অন্যকে দিয়ে সেই চিঠি সে পড়িয়ে নেবে। হয়তো মাকে দিয়ে পড়াবে। কেউ যখন চিঠি পড়ে শোনায় তখন ফুলির মা গালে হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকে। তখন তাকে দেখে মনে হয় জগতের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সে করছে। এতদিন দেশ থেকে আসা তার সব চিঠি আমি পড়ে শুনিয়েছি। তার হয়ে চিঠি লিখে দিয়েছি আমি। ফুলির মা লেখাপড়া না জানলেও চিঠি লেখার সব কায়দাকানুন জানে। খুব ভালো করে জানে।
আফা, চিডির উফরে সুন্দর কইরা লেহেন সাতশ ছিয়াশি।
সাতশ ছিয়াশি লিখব কেন?
এইটা আফা চিডির দস্তুর। লেহেন সাতশ ছিয়াশি।
লিখলাম।
এহন লেখেন– পাক জনাবেষু, বাদ সমাচার…।
হুঁ লিখলাম।
ফুলির মা’র জন্যে চিঠি লেখা খুবই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কত কী যে সেই চিঠিতে থাকে! তার দেশের কে কেমন আছে সব জানতে চাওয়া হয়। কার অসুখ হয়েছে, কোন মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে… ফুলির মা’র জন্যে চিঠি লিখতে লিখতে সব আমার জানা হয়ে গেছে।
তার গ্রামে আমি যদি কখনো বেড়াতে যাই তাহলে সবাইকেই আমি চিনব।
ফুলির মা’র প্রতিটি চিঠি লেখা হবার পর তাকে পড়ে শুনাতে হয়। সে প্রায় দম বন্ধ করে চিঠি শুনে, তারপর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে। সাদামাটা চিঠি পড়ে তার চোখে পানি আসে কেন কে জানে।
আমি ঠিক করেছি আমি প্রতিটি চিঠি শেষ করে ফুলির মা’র মতো একটু কাঁদব। এক ফোঁটা হলেও চোখের পানি চিঠির কোনো এক কোনায় মাখিয়ে রাখব। চোখের পানি শুকিয়ে যাবে, কেউ বুঝতে পারবে না। সেই ভালো। আমি চিঠি লিখা শুরু করলাম।
আগে আমি খুব দ্রুত লিখতে পারতাম– এখন পারি না। প্রায় সময়ই চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে- আন্দাজে লিখতে হয়। হাতের লেখা খারাপ হয়ে যায়। একসময় আমার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। আমি নিজে যেমন অসুন্দর হচ্ছি। আমার লেখাও তেমনি অসুন্দর হচ্ছে।
৭৮৬
প্রিয় ফুলির মা বুয়া,
তুমি আমার ভালোবাসা নাও।
তুমি যখন আমার এই চিঠি পড়বে তখন আমি বেঁচে থাকব না। মৃত্যুর পর পর মৃত মানুষটিকে সবাই দ্রুত ভুলে যেতে চেষ্টা করে। সেটাই স্বাভাবিক। যে নেই– বার বার তার কথা মনে করে কষ্ট পাবার কোনো কারণ নেই। তারপরেও যারা অতি প্রিয়জন তারা মৃত মানুষকে সবসময়ই মনে রাখে। এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না। মৃত মানুষও হয়তো জীবিতদের মনে রাখে।
তুমি আমার অতি প্রিয়জনের একজন। প্রিয়জন কে হয় তা কি তুমি জানো? প্রিয়জন হচ্ছে সে যে দুঃখ ও কষ্টের সময় পাশে থাকে।
বেশিরভাগ মানুষের স্বভাব হচ্ছে বিড়ালের মতো। তারা সুখের সময় পাশে থাকে। দুঃখ-কষ্ট যখন আসে তখন দুঃখ কষ্টের ভাগ নিতে হবে এই ভয়ে চুপি চুপি সরে পড়ে। তাদের কোনো দোষ নেই– আল্লাহ মানুষকে এমন করেই তৈরি করেছেন।