বাবা বললেন, আজ আকাশের অবস্থা বেশি সুবিধার না। মনে হচ্ছে আজই বৃষ্টি হবে। একসাথে নেমে পড়া যাক কী বলিস।
আমি বললাম, হুঁ।
ফুলির মাকে দলে টানতে হবে। নয়তো সে ফাঁস করে দেবে।
ফুলির মাকে নিয়ে ভয় নেই বাবা। আমি ওকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠিক করে রাখব।
বাবা চলে গেলেন মোমবাতি এবং মোটা দড়ি কিনতে। এই পরিকল্পনায় খুব শক্ত এবং মোটা দশ গজের মতো দড়ি লাগে। মোমবাতি লাগে।
আমি উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছি। মাঝে মাঝেই জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি আর ভাবছি- ইস, আকাশটা যদি আরেকটু কালো হতো
বাবা দড়ি-টড়ি নিয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই মা অফিস থেকে ফিরলেন। বাবাকে সবকিছু তড়িঘড়ি করে আমার খাটের নিচে লুকিয়ে ফেলতে হলো।
বাবা বললেন, আজ টিকিট কাটার কথা ছিল না? কেটেছ?
মা জবাব দিলেন না। কঠিন এবং রাগী চোখে বাবার দিকে তাকালেন। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার সেই ভয়ঙ্কর, কুৎসিত এবং নোংরা ব্যথাটা শুরু হয়ে গেল।
আমার ব্যথার এই তীব্রতা মা আগে কখনো দেখেন নি। এই প্রথম দেখেছেন। তিনিও বাবার মতোই করলেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। আমি বললাম, মা, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থেকো না। তুমি চলে যাও। চলে যাও।
বাবা যেভাবে পালিয়ে গিয়েছিলেন, মাও ঠিক সেই ভাবেই পালিয়ে গেলেন। কোরান শরীফ নিয়ে দৌড়ে এলো ফুলির মা। আর তখন ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামল। শুধু যে বৃষ্টি তা না– বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ও শুরু হলো।
প্রচণ্ড বর্ষণ হচ্ছে
প্রচণ্ড বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। এই ঝড়-বাদল মাথায় নিয়ে দিলশাদ এগুচ্ছে। রিকশাওয়ালার পর্দাটা ফুটো। বৃষ্টির পানিতে তার শাড়ি মাখামাখি। বৃষ্টির পানিতে গা ভেজানো যায় কিন্তু দ্রুতগামী ট্রাকের চাকা থেকে ছিটকে আসা পানিতে ভিজলে গা ঘিন ঘিন করে।
একটা ট্রাক এসে দিলশাদকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। তবে দিলশাদের গা ঘিন ঘিন করছে না। সে মূর্তির মতোই রিকশায় বসে আছে। রিকশাওয়ালা মাথায় গামছা বেঁধে নিয়েছে। এতে তার কী উপকার হচ্ছে কে জানে। গামছা থেকে চুঁইয়ে পানি পড়ছে। সে পেছন ফিরে বলল, এমুন দিনে ঘর থাইক্যা বাইর হওন ঠিক না আম্মা। আসমান ভাইঙ্গা পড়ছে। দেহেন অবস্থা।
.
অনেকক্ষণ কলিংবেল বাজার পর দরজা খুলল। ওয়াদুদুর রহমান বলল, আরে তুমি। বৃষ্টিতে একেবারে দেখি মাখামাখি।
দিলশাদ বলল, আসব দুলাভাই?
এসো এসো। তুমি আসবে না তো কে আসবে।
আপনার কার্পেট বোধহয় ভিজিয়ে ফেললাম।
ভিজুক না কত ভিজবে।
দিলশাদ ঘরে ঢুকল। ওয়াদুদুর রহমানের দিকে তাকাল। শান্ত সহজ গলায় বলল, আমি টাকাটার জন্যে এসেছি। আসুন আপনার বাথটাব উদ্বোধন করা যাক।
ওয়াদুদুর রহমান বলল, ও।
ওয়াদুদুর রহমান চোখ সরু করে তাকাচ্ছে। তার ভুরু একটু যেন ঝুঁকে এসেছে। দিলশাদ নিজেই বসার ঘরের খোলা দরজা বন্ধ করতে করতে বলল, আসুন, আপনার বাথটাব উদ্বোধন করা যাক। ময়লা পানিতে শরীর নোংরা হয়ে আছে। নোংরা শরীর নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে না। আগে সাবান মেখে ভালো করে গোসল করে নেই।
.
০৯.
আজ বৃহস্পতিবার।
শুক্র-শনি-রবি, এই তিনদিন আমার হাতে আছে। সোমবার আমি চলে যাচ্ছি। সোমবার রাত দুটায় আমাদের বিমান। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার সঙ্গে মা যাচ্ছেন না। যাচ্ছেন বাবা। বাবার জন্যেই টিকিট কাটা হয়েছে।
এরকম একটা কাণ্ড যে শেষ মুহূর্তে মা করবেন তা আর কেউ না জানলেও আমি জানতাম। যেদিন বাবা খুব ব্যস্ত হয়ে তার পাসপোর্ট নিয়ে এসে মাকে বললেন— দিলশাদ, আমিও তোমাদের সঙ্গে ভিসা করিয়ে রাখি। যদি টাকাপয়সা বেশি জোগাড় হয়ে যায় আমিও যাব।
আমি মার দিকে তাকালাম। মা চোখ-মুখ কঠিন করে বললেন, টাকাটা আসবে কোত্থেকে? আকাশ থেকে?
বাবা আমতা আমতা করতে লাগলেন। তার এক বন্ধু আছে জার্মানিতে, তাকে চিঠি লিখবেন– এইসব কী হাবিজাবি বলতে লাগলেন। মা বাবার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। মার চোখ দেখেই বুঝলাম শেষ মুহূর্তে মা বাবার জন্যেই টিকিট কাটবেন। কারণ মা’র কঠিন চোখে মমতার ছায়া পড়ছিল। বাবা যখন খুব বেশিরকম আমতা আমতা করতে লাগলেন– তখন মার চোখে একধরনের রসিকতা ঝলমলিয়ে উঠল। সেদিন আমি ডায়েরিতে লিখলাম–আমার ধারণা, আমেরিকায় মা আমার সঙ্গে যাবেন না। বাবা যাবেন।
ডায়েরিতে লিখে আমি মনে মনে অপেক্ষা করছি– দেখি আমার কথা ঠিক হয় কি-না। তারপর একদিন মা টিকিট কেটে দুপুরবেলা বাসায় এলেন। বাবা বাসাতেই ছিলেন। তিনি কোত্থেকে যেন একটা ধাঁধা শিখে এসেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি পারলাম না। ফুলির মাকে জিজ্ঞেস করলেন- ফুলির মাও পারল না। আমি তখন বাবাকে বললাম, মাকে জিজ্ঞেস কর। মা পারবে। মা’র বুদ্ধি অনেক বেশি। বাবা বললেন, তোর মা পারবে না। যাদের বুদ্ধি বেশি তারা এটা পারে না। যাদের বুদ্ধি বেশি তারা চট করে জবাব দিতে গিয়ে ভুল করে।
যাই হোক, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন মা আসবে, বাবা মা’কে ধাঁধাটা জিজ্ঞেস করবে।
মা এলেন। খুব ক্লান্ত হয়ে এলেন। এসেই বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে আমার ঘরে এলেন। আমি বললাম, মা, বাবা তোমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করবে।
মা বললেন, ধাঁধা জিজ্ঞেস করার দরকার নেই।