কথা বলতে গিয়ে মার গলা ধরে গেল, কিন্তু ফুলির মা নির্বিকার ভঙ্গিতে কর্কশ গলায় বলল, আমার নিজেরও ঘর-সংসার আছে। কইলেই আওন যায় না।
তাকে যে এত কিছু দেয়া হলো সেটা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। যাবার সময় আমাকে বলে পর্যন্ত গেল না। নতুন শাড়ি, স্যান্ডেল পরে, গট গট করে রিকশায় গিয়ে উঠল। ফুলির মা চলে যাবার পর আমার তার জন্যে এত খারাপ লাগল যে আমি দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কাঁদলাম।
এই যে ভালোবাসা আমি ফুলির মা’র প্রতি দেখালাম সে কি সেই ভালোবাসা ফেরত দেবে না? বাংলা আপার কথা অনুযায়ী দেয়া উচিত। মনে হয় সে আমার জন্যে কাঁদবে। তবে খুব অল্প সময়ের জন্যে কাঁদবে। আমার মনে আছে তার নিজের মেয়ে ফুলির মৃত্যুর খবর পেয়েও সে খুব অল্প সময়ের জন্যে কাঁদল। ‘ফুলিরে, ও ফুলি, ও ধন, ও আমার মানিকরে’ বলে হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কেঁদে বালতি ভর্তি কাপড় নিয়ে বাথরুমে কাপড় ধুতে গেল। বাবা বললেন, ফুলির মা, থাক আজ কাপড় ধোয়ার দরকার নেই।
ফুলির মা রাগী গলায় বলল, কাম ফালাইয়া থুইয়া কোনো লাভ আছে? কাপড় ধুইব কে? আফনে ধুইবেন?
বাথরুমে কাপড় ধুতে ধুতে সে আরেকবার ‘ফুলিরে, ও ধন রে, ও আমার মানিকরে’ বলে চেঁচিয়ে উঠেই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেল। আর কোনোদিন তাকে ফুলির জন্যে কাঁদতে শুনি নি।
আমার জন্যেও সে হয়তো দুবার কাদবে। একবার মৃত্যুর খবর শুনে কাদবে। আরেকবার কোনো একটা কাজ করতে করতে কাদবে। তবে বেশিও কাঁদতে পারে। নিজের মেয়েকে সে তো কখনো কাছে পায় নি। আমাকে কাছে পেয়েছে। নিজের মেয়ের প্রতি তার যে ভালোবাসা ছিল তার সবটাই নিয়ে নিয়েছি আমি। আমার যখন সেই ভয়ঙ্কর মাথাব্যথাটা হয় ঘরে যখন সে আর আমি ছাড়া কেউ থাকে না তখন অসহ্য ব্যথা নিয়েও অবাক হয়ে ফুলির মা’র কাণ্ডকারখানা আমি দেখি। আমার বড় মায়া লাগে।
প্রথম কিছুক্ষণ সে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চেহারা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। দ্রুত তার ঠোঁট নড়তে থাকে। মনে হয় সে তখন কোনো দোয়া পড়তে থাকে। আমি বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকি, সে দরজা ধরে ছটফট করতে থাকে। একসময় ছুটে গিয়ে লাল কাপড়ে মোড়া কোরান শরীফ এনে আমার মাথায় চেপে ধরে, এবং কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে ও আল্লা, পাক কালামের দোহাই লাগে। ও আল্লা, পাক কালামের দোহাই লাগে।
আমার ব্যথা একসময় কমতে থাকে। ফুলির মা’র ধারণা কোরান শরীফ মাথায় চুঁইয়ে পাক কালামের দোহাই দেয়াতে ব্যথা কমেছে।
আজ পাক কালামের দোহাই-এও কাজ হয় নি। দুপুরে খাবার পর শুয়ে আছি। বাবা বললেন, টিয়া, আমাকে একটু জায়গা দে তো মা, তোর পাশে শুয়ে থাকি। আজ কেন জানি মারাত্মক ঘুম পাচ্ছে।
আমি বললাম, আমার বিছানায় কষ্ট করবে কেন। মা’র বড় বিছানায় আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাও।
বাবা বললেন, দরকার নেই। আমি ঘুমুচ্ছি, এর মধ্যে তোর মা যদি চলে আসে তাহলে ভয়ঙ্কর ব্যাপার শুরু হবে।
আমি বললাম, তোমাদের এইসব ঝামেলা কবে মিটবে বলো তো?
বাবা রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন, খুব শিগগির মিটবে। আমি এমন এক পরিকল্পনা করেছি না মিটে উপায় নেই।
পরিকল্পনাটা কী?
তোকে বলা যাবে না।
আমাকে বলল– আমি তোমাকে সাহায্য করব।
সাহায্য করবি?
হুঁ।
তোর মা’র সঙ্গে তোর যা খাতির পরে একদিন তুই তোর মা’কে ফাস করে দিবি- আমি পড়ব মহাযন্ত্রণায়।
কোনোদিন ফাঁস করব না বাবা।
তাহলে শোন…।
এই বলে যেই বাবা আমার পাশে বসলেন, ওমনি আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। তীব্র ভয়াবহ যন্ত্রণায় মাথা টুকরো টুকরো হবার জোগাড় হলো। মনে হচ্ছে সূর্যটা দুভাগ হয়ে আমার দুচোখে ঢুকে পড়েছে। আমি গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগলাম, আমার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে শুরু করল। ফুলির মা কোরান শরীফ হাতে ছুটে এসে বলতে লাগল আল্লাহ পাকের পাক কালামের দোহাই। আল্লাহ পাকের পাক কালামের দোহাই।
বাবা আমার পাশে বসেছিলেন। তিনি হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, হাত দিয়ে আমাকে ছুঁলেন না। তিনি থর থর করে কাঁপছেন। আমি গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বললাম, বাবা তুমি চলে যাও। বাবা তুমি চলে যাও।
বাবা ছুটে দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন। তারো অনেক অনেক পরে ব্যথা কমল। আমি তাকালাম ফুলির মা’র দিকে– ফুলির মা’র সারা শরীর ঘামে ভিজে চপচপ করছে। মনে হচ্ছে এই এক্ষুনি সে বুঝি গোসল সেরে ফিরল।
আমি হাসিমুখে বললাম, বুয়া ঠাণ্ডা পানি খাব।
ফুলির মা পানি আনতে যাচ্ছে। সে ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। এলোমেলোভাবে পা ফেলছে। আজ বেচারির উপর দিয়ে খুব বড় ঝড় গেছে।
বাবার উপর দিয়েও ঝড় গেছে। বেচারা বাবা– কী ভয়ঙ্কর কষ্টই না পেয়েছে। ভয়ঙ্কর কষ্ট না পেলে এই অবস্থায় মেয়েকে ফেলে কেউ পালিয়ে যায়?
বাবা সে-রাতে আর ফিরলেন না। পরদিন নটার দিকে এলেন। গতদিনের অসুখ নিয়ে আমি এবং বাবা দুজনেই কেউ কোনো কথা বললাম না। দুজনই এমন ভাব করলাম যেন গতদিন কী ঘটেছিল আমরা ভুলে গেছি।
বাবার পরিকল্পনা শুনলাম। খুব হাস্যকর পরিকল্পনা, তবে আমার মনে হচ্ছে কাজ করবে। পরিকল্পনা কাজ করার জন্যে ঝড়বৃষ্টি দরকার এবং ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া দরকার। ঝড় যদি নাও হয় ভালো বৃষ্টি হলেও চলবে, তবে ইলেকট্রিসিটি চলে যেতে হবে। পুরো ঢাকা শহরের ইলেকট্রিসিটি চলে যাবার দরকার নেই আমাদের ফ্ল্যাট বাড়ির ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেই হবে। এই সমস্যার সমাধান ফ্ল্যাটবাড়ির কেয়ারটেকারকে দিয়ে করানো যায়। তাকে চা-টা খাবার জন্যে কিছু টাকা দিলেই সে নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের জন্যে মেইন সুইচ অফ করে রাখবে। এখন অপেক্ষা শুধু বৃষ্টির।