মা একটু নড়েচড়ে বসলেন, তারপর বললেন, নাতাশা, তোর বাবা এত সকাল সকাল চলে গেল কেন?
আমি জবাব দিলাম না। এই প্রশ্ন মা আমাকে করেন নি। নিজেকেই করেছেন। মানুষ নিজেকে সরাসরি প্রশ্ন করতে ভয় পায়। এইজন্যে বেশিরভাগ সময়ই নিজেকে করা প্রশ্ন অন্যকে করে। তবে অন্যের কাছে থেকে সে জবাব শুনতে চায় না। কেউ জবাব দিলে তার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়।
আমার ধারণা, মা কোনো বড় সমস্যায় পড়ে গেছেন। এই সমস্যায় বাবা কোনো না কোনোভাবে জড়িত বলে বারবার তার বাবার কথা মনে পড়ছে।
মা উঠে দাঁড়ালেন এবং আজ সারাদিন আমি কেমন ছিলাম, আমার ব্যথা উঠেছিল কি-না তা না জিজ্ঞেস করেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তার ঘরের দরজা বন্ধ করার ঘটনাটাও অনেকদিন পর প্রথম ঘটল। আমার অসুখের পর থেকে তিনি দরজা বন্ধ করেন না।
আজ আমার শরীর ভয়ঙ্কর রকম খারাপ করেছিল। সেই ভয়ঙ্কর যে কী রকম ভয়ঙ্কর তা আমি বাবা এবং ফুলির মা’র দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি। এরকম ভয়ঙ্কর খারাপ অবস্থা আমার বেশি হয় না। খুব কমই হয়। মা এটা এখনো দেখেন নি। কারণ যে ক’বার এই অবস্থা হলো– সে ক’বারই মা অফিসে। ব্যাপারটা জানল শুধু ফুলির মা। আমি তাকে বললাম, ফুলির মা, তুমি মা’কে এটা কখনো বলবে না। খবরদার। যদি তুমি মাকে বলে দাও তাহলে আমি কোনোদিন তোমার সঙ্গে কথা বলব না। :
মা’কে ব্যাপারটা জানাতে চাই নি– কারণ মা’কে জানিয়ে কী হবে? শুধু শুধু তার কষ্ট লক্ষগুণ বাড়িয়ে দেয়া হবে। তিনি অফিস-টফিস সব ছেড়ে দিন-রাত আমার বিছানার পাশে বসে থাকবেন। এতে যদি আমার লাভ হতো আমি নিজেই মা’কে বলতাম। লাভ তো কিছু হতো না। বরং এই যে মা অফিসে যাচ্ছে এতেই আমার লাভ হচ্ছে। আমি আশায় আশায় সময়টা কাটাচ্ছি– মা কখন ফিরবে? ফিরলে কী কী গল্প করব?
মানুষ তার জীবনের আনন্দের গল্পগুলি অন্যকে জানাতে চায়। দুঃখ এবং কষ্টের কথা কাউকে জানাতে চায় না। আমিও আমার কষ্টের ব্যাপার কাউকে জানাতে চাই না। কাউকেই না। আমি আমার কষ্টের ব্যাপারগুলি নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখতে চাই। মা নিজেও তো আমাকে লুকিয়ে রাখতে চাইছে। যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে গেলাম তখন মা যে কী কাণ্ড করল! এক গাদা মিষ্টি কিনে নিয়ে এসে আমাকে বলল, চল রে নাতাশা, ফ্ল্যাট বাড়িগুলিতে মিষ্টি দিয়ে আসি।
কারো বাসায় যেতে আমার খুব খারাপ লাগে। তারপরেও মা’র উৎসাহ দেখে বললাম, চল যাই। মা সবকটা ফ্ল্যাটে গেলেন। কী আনন্দ নিয়েই না মেয়ের রেজাল্টের কথা বললেন! আমার রেজাল্টের কথা শুনে অন্যরা কে কী করছে তা আমি দেখলাম না আমি শুধু মুগ্ধচোখে মাকেই দেখছিলাম। মা আমাকে যখন ফোর-বি ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন তখন মজার একটা ব্যাপার হলো। ফোর-বি ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলা (তার অনেক বয়স। প্রায় আমার নানিজানের কাছাকাছি) দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন– আরে নাতাশা, তুমি? আমি অবাক হলাম ভদ্রমহিলা আমার নাম জানেন দেখে। আমি তাকে কোনোদিন দেখিও নি। মা তাকে আমার রেজাল্টের কথা বললেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলা এমন হৈচৈ শুরু করলেন। প্রথমেই চিৎকার করে উঠলেন– ও আল্লা, ও আল্লা, এ কী কাণ্ড! এ কী কাণ্ড! তারপর ছুটে গেলেন টেলিফোন সেটের কাছে। তিনি টেলিফোনে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছেন। আমি আর মা শুনছি।
হ্যালো! শোন শোন, তুমি যে প্রায়ই বলতে আমাদের ফ্ল্যাট বাড়িতে একটা পাগলা মেয়ে আছে– বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা কথা বলে আর হাত নেড়ে নেড়ে বক্তৃতা দেয়– সেই মেয়ে আর তার মা এসেছে। এই তত দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। এই শোন, মেয়েটা ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় ফাস্ট হয়েছে।
আমার আনন্দের খবরটা মা ঘরে ঘরে গিয়ে দিয়ে এলেন। কিন্তু অসুখের ব্যাপারটা কাউকে বললেন না। অনেকে নিজ থেকে খবর পেয়ে দেখতে এলো, মা তাদের কাউকেই আমার কাছে আসতে দিলেন না। শুকনো গলায় বললেন, কিছু মনে করবেন না, ওর কাছে যাওয়া ডাক্তারের নিষেধ আছে। কেউ ওকে দেখতে গেলে ও মনে কষ্ট পায়, সেটা ওর ক্ষতি করে। মার কঠিন নিষেধের জন্যে কেউ আর কাছে আসতে পারল না শুধু ঐ মহিলা আসতেন। মা যখন অফিসে তখন আসতেন। মা সেটা জেনে ফেলে একদিন খুব রাগারাগি করলেন। তারপরেও উনি আসতেন। আমার একটা হাত কোলে নিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে যেতেন। কোনো গল্প না, কিছু না। গল্প আমি করতাম, উনি শুধু শুনতেন। উনি আমাকে খুব দামি একটা কলম আর একটা খাতা দিয়েছেন। এত সুন্দর খাতা আমি জন্মে দেখি নি। মলাটটা হালকা বেগুনি ভেলভেটের। খাতাটা হাতে নিলেই গালে ছোঁয়াতে ইচ্ছা করে। এখন পর্যন্ত ঐখাতায় আমি কিছু লিখি নি। আমি ঠিক করে রেখেছি আমেরিকা যাবার আগে সবার জন্যে ঐ খাতায় একটা করে চিঠি লিখে যাব। ফুলির মা’র জন্যেও লিখব।
আমার মৃত্যুর খবর এলে ফুলির মা কতটা কষ্ট পাবে তা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। মনে হয় খুব একটা পাবে না। বাবার এই ব্যাপারে একটা থিওরি আছে– আনন্দ পাবার ক্ষমতা যার যত বেশি, কষ্ট পাবার ক্ষমতাও তার তত বেশি।
ফুলির মা’র আনন্দ পাবার ক্ষমতা একেবারেই নেই। তাকে গত ঈদের আগের ঈদে মা খুব ভালো একটা শাড়ি কিনে দিল। অনেকদিন পর দেশে যাচ্ছে ভালো একটা শাড়ি পরে যাক। শুধু শাড়ি না শাড়ির সঙ্গে স্যান্ডেল, গায়ে দেয়ার একটা চাঁদর। তার সাতশ টাকা পাওনা হয়েছিল। মা তাকে এক হাজার টাকা দিয়ে বলল, তোমার কাজকর্ম, চাল চলন, বিড়ি সিগারেট খাওয়া সবই অসহ্য; তারপরেও তুমি ছিলে বলে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। তুমি চলে যাবার পর বাসাটা খালি খালি লাগবে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।