ওয়াদুদুর রহমান অন্যহাত দিলশাদের কোলে রেখেছে। অনেকদিন আগে সিনেমাহলে এই ব্যাপার হয়েছিল।
দুলাভাই, আপনি ঠিক করে বলুন তো আপনি আমার কাছে কী চাচ্ছেন?
আমি নিজ থেকে কিছু চাইব না। তুমি যা দেবে তাই হাসিমুখে নেব। হা হা হা।
ওয়াদুদুর রহমান দিলশাদের দিকে আরেকটু ঝুঁকে এলো। দিলশাদ বলল, দুলাভাই, আমার গায়ের উপর উঠে পড়ার আগে একটা কথা শুনুন। প্লিজ স্টপ দেয়ার। আমার গাল থেকে আপনার হাত সরান। হ্যাঁ, এখন তাকান আমার দিকে। আমাকে বেশ কিছু টাকা আপনি দিচ্ছেন। তার পূর্বশর্ত কি এই যে, আমাকে আপনার সঙ্গে বাথটাবে বসে গোসল করতে হবে? আপনার সঙ্গে আমাকে বিছানায় যেতে হবে?
তুমি পুরো ব্যাপারটা অন্যভাবে দেখছ দিলু। অন্যভাবে দেখার দরকার নেই– আমরা দুজনই র্যাশানাল হিউমেন বিং…।
দুলাভাই, আপনার টাকার আমার দরকার নেই।
দরকার না থাকলে খুব ভালো কথা। দরকার নেই বলেই তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে কেন?
আমি তো আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছি না। আপনি করছেন। কতটুক খারাপ ব্যবহার যে করেছেন তাও আপনি জানেন না।
দিলশাদ উঠে দাঁড়াল। ওয়াদুদুর রহমান স্বাভাবিক গলায় বলল, চলে যাচ্ছ?
দিলশাদ জবাব না দিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে এলো। সে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। একহাতে রেলিং ধরে নামছে, তারপরেও মনে হচ্ছে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
মার কিছু একটা হয়েছে
মা’র কিছু একটা হয়েছে। ভয়ঙ্কর কিছু। রাত আটটায় মা বাসায় ফিরলেন– আমি তাঁকে দেখেই চমকে উঠলাম। মা বললেন, তোর বাবা কোথায়? চলে গেছে? আমি বললাম, হু। মা ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমার খাটের পাশে বসলেন। বসেই রইলেন। যেন রক্ত-মাংসের মানুষ হঠাৎ মূর্তি হয়ে গেছে।
অন্যদিন বাসায় ফিরে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন– মাথাব্যথা হয়েছিল? তারপর কিছুক্ষণ মাথায় হাত রাখেন। মনে হয় মনে মনে কোনো দোয়া পড়েন। মা কিছুদিন হলো দোয়া পড়া শুরু করেছেন। দরূদে শেফা। অনেক রাত জেগে পড়েন, তারপর চুপিচুপি এসে কপালে ফুঁ দিয়ে যান। আমি জেগে থেকেও ঘুমিয়ে থাকার ভান করি।
মা’র মন আজ খুব ভালো থাকার কথা। আজ আমাদের ভিসা হয়েছে। কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই হয়েছে। ভিসা হবার পর মা আমাকে আর বাবাকে বাসায় নামিয়ে রেখে চলে গেলেন। যাবার সময় হঠাৎ কী মনে করে বাবাকে বললেন, তুমি রাতে ভাত না খেয়ে চলে যাও কেন? আজ ভাত খেয়ে যাবে।
মার কথা শুনে বাবা যেমন আশ্চর্য হলেন, আমিও হলাম। অনেকদিন পর এই প্রথম মা বোধহয় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাবার সঙ্গে কথা বললেন। আমার ধারণা, বাবাকে তিনি রাতে থেকে যেতে বলতেন। চক্ষুলজ্জার জন্যে বলতে পারলেন না। সেই মা’র কী হলো? এমন মন খারাপ করে ফিরলেন কেন?
আমি মার দিকে তাকিয়ে কারণটা ধরতে চেষ্টা করলাম। একটা কারণ হতে পারে– মা সব ঠিকঠাক করার পর হঠাৎ ধরতে পেরেছেন– সবই অর্থহীন।
মা ডাকলেন, ফুলির মা!
ফুলির মা দরজা ধরে দাঁড়াল। তার এখন ধমক খাওয়ার কথা। দরজা ধরে দাঁড়ালেই মা ধমক দেন। কিন্তু আজ সে ধমক খেল না। মনে হচ্ছে সে যে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মা যেন এটা দেখতে পাচ্ছেন না। ফুলির মা বলল, আম্মা কী?
মা এই প্রশ্নে কেমন যেন বিব্রত হলেন। মনে হচ্ছে কেন ফুলির মাকে ডেকেছেন তা তিনি ভুলে গেছেন।
চা দিমু আম্মা?
না।
শীতল পানি দিমু?
আচ্ছা তুমি যাও।
ফুলির মা চলে গেল। একবার ভাবলাম মাকে জিজ্ঞেস করি তোমার কী হয়েছে মা? তারপর মনে হলো কেউ যখন খুব কষ্টে থাকে তখন প্রশ্ন করে কষ্টের ব্যাপারটা জানতে নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কষ্টের উপর প্রলেপ পড়ে। তখন জিজ্ঞেস করা যায়। প্রলেপ বাড়ার আগেই কষ্টের ব্যাপার জানতে চাইলে কষ্টটা অসহনীয় হয়ে ওঠে।
এই থিওরি আমার বাবার কাছ থেকে শোনা। বাবা থিওরি দেবার মধ্যে খুব ওস্তাদ। মার ধারণা অকর্মণ্য, অপদার্থ লোক থিওরি দেয়াতে ওস্তাদ হয়। এরা কাজ জানে না। থিওরি জানে। মা’র কথা সত্যি হলেও হতে পারে। আমি দেখেছি মার কথা সাধারণত সত্যি হয়। বাবার সাইনবোর্ড উল্টানোর গল্পটা শুনে মা বললেন– এটা মিথ্যা গল্প। বানিয়ে বানিয়ে বলছে। মার কথা শুনে আমার খুব রাগ হয়েছিল। গতকাল বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম।
ঠিক করে বলো তো বাবা গল্পটা কি সত্যি? মা বলছে মিথ্যা গল্প।
এই গল্পের সত্যি-মিথ্যা তোর মা বলবে কীভাবে? সে তো সাইনবোর্ড বদলানোয় ছিল না।
তুমি তাহলে সাইনবোর্ড বদলেছ?
প্রায় আর কী!
প্রায় মানে কী?
এই জাতীয় একটা পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল… হাতুড়ি, পেরেক সবই জোগাড় করা হলো…।
শেষপর্যন্ত আর বদলাও নি, তাই না?
হুঁ।
বাবার কথায় আমরা মনটা বেশ খারাপ হলো। মজার একটা ঘটনা বাবা ঘটিয়েছিলেন এটা ভেবে যে কতবার একা একা খিলখিল করে হেসেছি– আর কখনো হাসতে পারব না। মনে মনে ভাবা এককথা, আর সত্যিকার কাজটা করে ফেলা অন্যকথা। আমি তো কত কিছুই ভাবি কিন্তু কিছুই করি না। মানুষের করার ক্ষমতার চেয়ে ভাবার ক্ষমতা লক্ষগুণ বেশি।
.
মা আমার পাশে বসে আছেন। তিনি এখন নিশ্চয়ই আকাশ-পাতাল কত কী ভাবছেন। কী ভাবছেন তা জানতে ইচ্ছা করছে। মানুষ কী ভাবে তা জানার ব্যবস্থা থাকলে খুব ভালো হতো। ভাবনাটা যদি চোখের মণিতে ভেসে উঠত! সেটাও বোধহয় সম্ভব না। মানুষ একসঙ্গে দুটা-তিনটা ভাবনা ভাবতে পারে। চোখের মণিতে তো আর একসঙ্গে দুটা-তিনটা ছবি ভাসতে পারে না।