তোর বাবারটা তোর বাবার। আমারটা আমার।
তুমি পেলে কোথায় এত টাকা?
তোর বাবার সবসময় ধারণা সে আমার আগে মারা যাবে— তখন আমি টাকা পয়সার সমস্যায় পড়ে যাব। আমার যাতে সমস্যা না হয় সেজন্যে সে পোস্টাফিসে পঞ্চাশ হাজার টাকা রেখেছিল। ঐটা বেড়ে বেড়ে এখন এক লাখ হয়েছে।
সেই টাকা আমাকে দিয়ে দেবে?
হ্যাঁ, শুধু তোর বাবা না জানলেই হলো।
মনোয়ারা এখনো মেয়ের পিঠ থেকে হাত সরিয়ে নেন নি। এখনো হাত দিয়ে রেখেছেন।
টাকাটা কি এখন নিবি দিলু? আমি উঠিয়ে রেখেছি।
দাও, এখনি দাও।
এতগুলি টাকা তুই একা নিয়ে যাবি?
কিছু হবে না। ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নিয়ে যাব। আজকাল হাইজ্যাকাররা মেয়েদের ভ্যানেটি ব্যাগ নেয় না। তারা জানে মেয়েরা অনেক সাবধান। ভ্যানিটি ব্যাগ হাইজ্যাক করে কিছু পাওয়া যাবে না। হাইজ্যাকাররা অনেকবার ‘ঠক খেয়েছে।
পাঁচশ টাকার দুটা বান্ডিল ভ্যানিটি ব্যাগে ভরতে ভরতে দিলু বলল, মা আমি চলোম।
সে-কী! তুই না বললি ভাত খাবি।
অনেক দেরি হয়ে যাবে মা। তাছাড়া আজ আমার দিনটা খুব লাকি। ভিসা হলো, তারপর হঠাৎ করে তোমার কাছ থেকে এতগুলি টাকা পেলাম। লাকি দিনটা এখানে বসে বসে নষ্ট করব না।
কী করবি?
বড় দুলাভাইকে ধরে আজই টাকার ব্যবস্থা করব। আমার মনে হচ্ছে আজ গেলে উনার টাকাটাও পাওয়া যাবে। আবার ইনশাল্লাহ বলতে ভুলে গেছি। ইনশাল্লাহ্।
এখন তার কাছে যাবি?
হুঁ।
সে নাকি আলাদা থাকে? ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। কী সব কাণ্ডকারখানা যে হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
তোমার কোনো মেয়েরই স্বামীভাগ্য ভালো না মা।
মনোয়ারা ক্লান্ত গলায় বললেন, আমার মেয়েগুলিরও তো দায়িত্ব আছে। মেয়েরা তাদের দায়িত্ব দেখবে না। শুধু পরের ছেলেদের দোষ দেবে এটা ঠিক না।
তুমি এক অদ্ভুত মহিলা মা– শুধু নিজেদের দোষ দেখবে, অন্যদের দোষ দেখবে না। আগের যুগের জন্যে তুমি ঠিক আছ, এই যুগের জন্যে তুমি মা ঠিক না।
যে ঠিক সে সব যুগের জন্যেই ঠিক।
তুমি তর্ক করো না তো মা। আমার সঙ্গে তুমি তর্কে পারবে না। শুধু শুধু তর্ক করতে এসো না।
আচ্ছা যা তর্ক করব না।
আমার মেয়েকে তুমি দেখতে আস না কেন?
আছে একটা কারণ।
সেই কারণটা কী শুনি।
আমি আর তোর বাবা মিলে একটা খতম পড়ছি। খতম শেষ হলে দুজন একসঙ্গে গিয়ে তোর মেয়েকে দেখে আসব আর দোয়া করে আসব।
খতম শেষ হবে কবে?
লাগবে কয়েকদিন।
বাবার ঐ পীর যন্ত্রণা করছে, তাই না মা? তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে হয়েও ভণ্ড পীরকে সহ্য করে যাচ্ছ। আশ্চর্য!
পীর ভণ্ড হতে পারে। কিন্তু আমরা তো পড়ছি আল্লাহপাকের কালাম। সেখানে তো মা কোনো ভণ্ডামি আমরা করছি না।
যা ইচ্ছা কর। মা আমি যাই।
আচ্ছা মা যা। টাকাটা সাবধান।
তুমি নিশ্চিত থাক তো মা। কেউ আমার এই টাকা নিতে পারবে না। টাকাগুলির মধ্যে আমার মেয়ের জীবন। কারো সাধ্য নেই কোনো মা’র কাছ থেকে মেয়ের জীবন ছিনিয়ে নেয়।
তুই কি এখন তোর বড় দুলাভাইয়ের কাছে যাচ্ছিস?
হ্যাঁ।
ওর নতুন ফ্ল্যাটের ঠিকানা জানিস?
হুঁ।
ওকে বলিস তো আমার সঙ্গে একটু দেখা করতে।
বলব।
দু-একদিনের মধ্যেই যেন দেখা করে।
বলব। মা যাই?
আচ্ছা মা যা। খোদা হাফেজ মা।
.
ধানমণ্ডির এই ফ্ল্যাট বাড়িটি খুব আধুনিক। মাত্র চারতলা উঁচু ফ্ল্যাট। কিন্তু লিফট আছে দুটি। এন্ট্রির লবি পুরোটাই শ্বেতপাথরের। ধুলোমাখা জুতা পায়ে পাথরের লবীতে উঠতেও সংকোচ লাগে। মেয়ে রিসিপসনিস্ট কোনো ফ্ল্যাট বাড়িতে এখনো দেখা যায় না। এই বাড়িতে আছে। চশমাপরা ধারালো চেহারার মেয়ে। দিলশাদকে দেখে সে শুদ্ধ ইংরেজিতে বলল, ম্যাডাম, আপনি কোথায় যাবেন?
দিলশাদ ওয়াদুদুর রহমানের নাম বলল। ফ্ল্যাট নাম্বার থ্রি-সি।
আপনার কি আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
জি-না।
স্যার ফ্ল্যাটেই আছেন। আমি একটু কথা বলে দেখি। আপনার কী নাম বলব?
বলুন দিলশাদ।
রিসিপসনিস্ট মেয়েটি ইন্টারকমে নিচু গলায় কিছুক্ষণ কথা বলেই রিসিভার দিলশাদের দিকে এগিয়ে দিল–স্যার লাইনে আছেন। কথা বলুন।
দিলশাদ রিসিভার হাতে নিল।
হ্যালো দিলশাদ।
জি দুলাভাই।
তুমি এসেছ খুব ভালো হয়েছে। মনে মনে তোমাকে এক্সপেক্ট করছিলাম।
তাই বুঝি?
অফকোর্স তাই। চলে এসো। লিফটে করে চারতলায়। ফ্ল্যাট বাড়ি কেমন দেখছ?
ফ্ল্যাটবাড়ি দেখলাম কোথায়? শুধু তো লবি দেখছি।
লবি কেমন সেটাই বলো।
অসাধারণ! একেবারে ইন্দ্রপুরী।
দিলশাদ তার দুলাভাইয়ের তৃপ্তির হাসি শুনল। হাসিটা একটু অস্বাভাবিক শুনাল– যদিও অস্বাভাবিক শুনানোর কোনো কারণ নেই।
ওয়াদুদুর রহমানের পরনে লুঙ্গি খালি গা। দিলশাদ কলিংবেলে হাত রাখার আগেই দরজা খুলে ওয়াদুদুর রহমান বলল, সুস্বাগতম।
দিলশাদ বলল, জুতা বাইরে রেখে ঢুকব, না জুতা পায়ে ঢুকব? যে অপূর্ব ফ্ল্যাট, জুতা পায়ে ঢুকতে সাহস হচ্ছে না।
ওয়াদুদুর রহমান খুশি খুশি গলায় বলল, ঢং করবে না দিলু। এসো এসো, ঘরে পা দাও।
সে দিলুর হাত ধরে ভেতরে টেনে নিল। দিলু একটু সংকোচিত বোধ করছে। দিলু ঢুকতে যাচ্ছে, তাকে হাত ধরে টানাটানির প্রয়োজন ছিল না।
ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন কেমন দেখছ?
খুব সুন্দর। শুধু এই সুন্দরের ভেতর লুঙ্গি পরা খালি গায়ে আপনাকে মানাচ্ছে না। বাংলা ছবির বিত্তবান বাবাদের মতো আপনার গায়ে থাকা উচিত ছিল রোব টোব জাতীয় কিছু। ফ্ল্যাটে আপনি একা?