নামাজের শেষে মনোয়ারা বললেন, মা আয়, দুজনে একসঙ্গে আল্লাহর কাছে দোয়া করি। হাত তোল। দুই মা একসঙ্গে আল্লাহর কাছে হাত তুলছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। মা’দের ব্যাপারে আল্লাহপাকের দুর্বলতা আছে।
দিলশাদ হাত তুলল। মনোয়ারা বেগম প্রার্থনা শুরু করলেন। তাঁর গলার স্বর নিচু কিন্তু প্রতিটি বাক্য স্পষ্ট।
হে পরম করুণাময়। তুমি করুণা কর। অবোধ নিষ্পাপ শিশুকে তুমি ভয়াবহ ব্যাধি দিয়েছ। কেন দিয়েছ তা তুমিই জানো। আমরা অতি ক্ষুদ্র মানুষ তোমার, কাজ বোঝার সাধ্য আমাদের নাই। বোঝার চেষ্টাও করব না। শুধু আমরা আমাদের মনের কষ্টের কথা তোমাকে জানাই। তুমি কষ্ট দূর কর আল্লাহপাক। ছোট্ট শিশুটাকে মুক্ত করে দাও।…
মনোয়ারা বেগম দোয়া করছেন। দিলশাদের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এমন ব্যাকুল হয়ে সে অনেকদিন কাঁদে নি। প্রাণভরে কাঁদার কারণেই হয়তো দিলশাদের মন খুব হালকা হয়ে গেল। নিজেকে তার এখন কিশোরী মেয়ের মতো লাগছে। বিয়ের আগে সে যেমন মাকে জড়িয়ে ধরে হৈচৈ চেঁচামেচি করত আজও সেরকম করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
দিলশাদ বলল, মা, তুমি আজ রাতে ভালো কিছু রান্না কর তো, আমি তোমার এখানে খাব।
কী খাবি বল?
তুমি যে কুচি কুচি করে ডিম দিয়ে আলু ভাজি কর ঐটা খাব।
শুধু আলু ভাজি? সঙ্গে আর কী খাবি?
তোমার দাঁতের যে অবস্থা– এই নিয়ে রাঁধবে কীভাবে? বরং আমাকে বলে দাও আমি রাধি।
দাঁতের ব্যথাটা এখন অনেক কমে গেছে। বুঝতে পারছি না কারণটা কী। তুই এরকম আরো কিছুক্ষণ হাসিমুখে থাকলে ব্যথাটা মনে হয় পুরোপুরি চলে যাবে।
মনোয়ারা হাসলেন। দিলশাদ বলল, তোমার বাগানে বসে চা খাব মা। চা বানিয়ে আন। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে, তাই না মা?
আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হতেও পারে।
বৃষ্টি হলে তোমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজব। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন তোমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতাম। মনে আছে মা?
হুঁ, মনে আছে।
যতবার বৃষ্টিতে ভিজতাম ততবারই বড় আপার ঠাণ্ডা লেগে গলা-টলা ফুলে বিশ্রী অবস্থা হতো।
মনোয়ারা হাসতে হাসতে বললেন, তোর বড় আপার অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। এখন বৃষ্টিতে ভিজতে হয় না। বৃষ্টি হচ্ছে এই শব্দ শুনলেই তার ঠাণ্ডা লেগে গলা ফুলে যায়। ব্যাঙের ডাক শুনলেও বোধহয় তার এখন ঠাণ্ডা লেগে গলা ফোলে।
দিলশাদ খিল খিল করে হাসছে। মনোয়ারা মুগ্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি অনেকদিন পর তার অতি আদরের এই মেয়েটিকে এমন প্রাণ খুলে হাসতে দেখলেন।
মনোয়ারা তার এই বাগান নিজের হাতে করেছেন। বাগানের যে শৃঙ্খলা থাকে এখানে তা অনুপস্থিত। মনোয়ারা যেখানে যে গাছ পেয়েছেন লাগিয়েছেন। সম্প্রতি আঙুরের লতা লাগানো হয়েছে। লতা অনেকদুর উঠেছে। মাচা বেঁধে দিতে হয়েছে। একটা পানগাছ আগেই ছিল। সেই পানগাছ মানকচুর পাতার মতো বিশাল পাতা ছেড়েছে। বরই গাছ আছে, নারকেলি বরই। একবার এই বরই খেয়ে খুব ভালো লেগেছিল। কয়েকটা বিচি নিজের হাতে পুঁতে দিলেন। একটি থেকে চারা বের হয়েছে। সেই চারা লক লক করে বাড়ছে। কাজি পেয়ারার কয়েকটা গাছ আছে– এখনো ফল ধরে নি। তার খুব শখ জলপদ্ম লাগানোর। ছোট্ট বাগানে আর জায়গা নেই- তবু তিনি মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা রেখেছেন। জায়গাটা খুঁড়ে জলাশয়ের মতো করে জলপদ্ম লাগাবেন। হাদিউজ্জামান সাহেবের ভয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করতে পারছেন না।
দিলশাদ পানগাছের পাশে দাঁড়িয়েছিল। খুঁটি বেয়ে এই গাছ অনেকদূর উঠে গেছে। মনোয়ারা চা হাতে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। দিলশাদ বলল, এটাই কি তোমার সেই বিখ্যাত পানগাছ?
হুঁ।
রাক্ষুসী পান বলে মনে হচ্ছে। এত বড় পাতা!
পাতাগুলি বেশি বড় হচ্ছে। এত বড় হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।
খেয়ে দেখেছ?
হুঁ। আমি তো এখন এই পানই খাই।
খেতে কেমন মা?
খেতে ভালোই, একটু কষটা কষটা।
আমাকে একটু দিও তো তোমার রাক্ষুসী পান, খেয়ে দেখব।
দিলশাদ ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসল। মনোয়ারা বসলেন মেয়ের পাশে।
তোর টাকা কী পরিমাণ জোগাড় হয়েছে রে দিলু?
হয় নি।
হয় নি! তাহলে এত নিশ্চিত আছিস কীভাবে?
নিশ্চিত তোমাকে কে বলল মা?
তোকে দেখে কেমন নিশ্চিত মনে হচ্ছে।
আমার কাছে এই মুহূর্তে তিন লাখ টাকার সামান্য বেশি আছে। বড় দুলাভাই তিন দেবেন। তাঁকে খুব ধরব যেন আরো এক বেশি দেন। কত হলো? সাত? আপাতত আমি এই নিয়ে রওনা হব।
আরো তো লাগবে।
হ্যাঁ লাগবে। আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী রীতা আছে মেরিল্যান্ডে। ওকে চিঠি লিখেছি। ও আমার থাকার ব্যবস্থা করবে। ও বলেছে আমেরিকায় অনেক বাংলাদেশী আছে। তাদের কাছ থেকে চাঁদা তুলবে। আগেও কয়েকবার এরকম তোলা হয়েছে। বিদেশে যেসব বাঙালি থাকেন, তাদের মন যে-কোনো কারণেই হোক—উদার হয়। ফেলো ফিলিংস থাকে। সমস্যা হবে না মা।
ইনশাল্লাহ্ বল দিলু। সমস্যা হবে না এ জাতীয় কথা কখনো বলবি না। সবসময় বলবি ইনশাল্লাহ সমস্যা হবে না।
দিলশাদ বলল, ইনশাল্লাহ সমস্যা হবে না।
মনোয়ারা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে এক হাত মেয়ের কাঁধে রেখে বললেন তোর জন্যে আমি কিছু টাকা রেখেছি।
দিলশাদ চমকে উঠে বলল, তুমি?
আমি তোকে বলেছিলাম না যেভাবেই হোক তোকে এক লাখ টাকা জোগাড় করে দেব।
বাবা তো দু লাখ টাকা দিয়েছেন।