যাবে না, তাহলে ভিসা করে রাখবে কী জন্যে?
শেষ মুহূর্তে যদি কিছু টাকা যোগাড় হয়ে যায়।
কোত্থেকে জোগাড় হবে? আলাদিনের চেরাগের কোনো সন্ধান পেয়েছ?
তা না। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু করিম জার্মানিতে আছে। ওর ঠিকানা জোগাড় করার চেষ্টা করছি। ও জানতে পারলে আমাকে টিকিট পাঠিয়ে দিবে।
টিকিট পাঠানোর দরকার নেই। উনাকে টাকা পাঠাতে বলল। টাকা কিছুই জোগাড় হয় নি।
সাজ্জাদ বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, নাতাশার চিকিৎসার সব খরচ দেয়ার পরেও যদি কিছু থাকে তাহলেই আমি যাব।
তোমার এত আগ্রহ কেন? ঐ দেশে মদ সস্তা, এইজন্যে?
সাজ্জাদের কিছু কঠিন কথা মুখে এসে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলেছে। কী হবে কঠিন কথা বলে? কঠিন কথা তোলা থাকুক। কোনো এক সময় বলা যাবে। সাজ্জাদ নিজের পাসপোর্ট করিয়েছে এবং দিলশাদের সঙ্গে ভিসার জন্য পাঠিয়েছে। দিলশাদ মুখ কঠিন করে রেখেছে। মেয়ের কথা ভেবেই হয়তো কিছু বলে নি।
ভিসা পেয়ে দিলশাদের ভালো লাগছে। ভিসা পাওয়া যাবে না এরকম সন্দেহ কয়েকদিন থেকেই তার হচ্ছিল। তাছাড়া যার সঙ্গে দেখা হয়েছে সে-ই বলেছে– আমেরিকান ভিসা? অসম্ভব। ওরা ভিসা দেবে না। কিছুতেই না।
দিলশাদ বলেছে, না দেয়ার কী আছে? আমরা ঐ দেশে বাস করার জন্যে যাচ্ছি না, চিকিৎসার জন্যে যাচ্ছি।
অন্যের চিকিৎসা নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই। চিকিৎসা হলেই কী আর হলেই কী?
ভিসা অফিসাররাও তো মানুষ।
আমেরিকান ভিসা অফিসার মানুষ তোমাকে কে বলল? ভিসা অফিসার হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়ার আগেই অপারেশন করে ওদের মাথায় কম্পিউটার বসিয়ে দেয়। ওরা হলো যন্ত্র। যন্ত্রের বেশি কিছু না। তোমার যাবতীয় কাগজপত্র উল্টে-পাল্টে দেখবে। তারপর শুকনো গলায় বলবে, সরি! নো।
ব্যাপার তা হয় নি। দিলশাদ যে-রকম চেয়েছে সেরকমই হয়েছে। শেষপর্যন্তও তাই হবে। সে তার মেয়েকে নিয়ে ভর্তি করাবে জন্স হপকিন্সে। পৃথিবীর সেরা সব ডাক্তার দিয়ে মেয়েকে পরীক্ষা করাবে। অপারেশন হবে এবং তার মেয়ে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরবে। মেডিকেল সায়েন্স অনেকদূর এগিয়ে গেছে। যারা এই বিজ্ঞানকে এতদূরে নিয়ে গেছেন দিলশাদ তাদের হাতেই মেয়েকে তুলে দেবে।
মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে সে কী করবে? প্রথমেই একমাসের ছুটি নেবে। এই একমাস দরজা বন্ধ করে শুধুই ঘুমুবে। এমনিতে ঘুম না এলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুবে। তার শরীর-মন অসম্ভব ক্লান্ত। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে ক্লান্তি দূর করবে।
নাতাশা গাড়িতে উঠেই বলল, মা’র অফিসের এই গাড়িটা খুব সুন্দর, তাই না বাবা?
সাজ্জাদ বলল, হ্যাঁ।
তোমার যদি কোনোদিন টাকা হয় এরকম একটা গাড়ি কিনো তো।
আচ্ছা মা কিনব। অবশ্যই কিনব।
দিলশাদ তিক্ত গলায় বলল, একটা খেলনা গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই, সে কিনবে পাজেরো। প্রমিজ করতেও লজ্জা লাগা উচিত।
নাতাশা মার দিকে তাকাল। সে মনে হয় বাবার পক্ষে কিছু বলতে যাচ্ছিল– বলল না। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
সাজ্জাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর মার অফিসের এই চমৎকার গাড়িতে করে শহরে কয়েকটা চক্কর দিলে কেমন হয়?
নাতাশা বলল, ভালো হয় বাবা, খুব ভালো হয়।
দিলশাদ বলল, ভালো হলেও চক্কর দেয়া যাবে না। গাড়ি অফিসে পাঠিয়ে দিতে হবে। আমার অফিসে কাজ আছে। আমি অফিসে গাড়ি নিয়ে চলে যাব।
মা, তাহলে আমরা রিকশা নিয়ে একটু ঘুরি?
না। প্রচণ্ড রোদ। মাথায় রোদ লাগবে।
.
মেয়েকে রোদে ঘুরতে না দিলেও দিলশাদ নিজে অনেকক্ষণ একা একা রিকশা নিয়ে। ঘুরল। ভিসা হাতে পেয়ে তার খুব আনন্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মেয়ের সুস্থ হয়ে ওঠার প্রথম ধাপটি শেষ হয়েছে। এই তো পাসপোর্টে ছমাসের ভিসার সিল মারা। প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যা শুরু হয় তা শেষও হয়। একদিন এই প্রক্রিয়া শেষ হবে।
আনন্দিত মানুষ নিজের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে চায়। আনন্দের খবর সবাইকে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করে। দিলশাদের পরিচিত জনের সংখ্যা সীমিত। সেই সীমিত সংখ্যক মানুষদের ঘরে ঘরে খবরটা পৌঁছাতে ইচ্ছা করছে। দিলশাদ প্রথম গেল কলাবাগানে তার মার কাছে।
হাদিউজ্জামান সাহেব বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তার পীর সাহেবের কাছে গিয়েছেন। মনোয়ারারও যাবার কথা ছিল। দাঁতের ব্যথার কারণে তিনি যান নি। দুদিন ধরে তিনি দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। আজ সেই ব্যথা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। গাল ফুলে একাকার।
দিলশাদ বলল, তোমার অবস্থা তো মা ভয়াবহ! তোমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
মনোয়ারা হাসলেন। দিলশাদ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এই অবস্থায় তুমি হাসছ কী করে মা?
মনোয়ারা বললেন, অনেকদিন পর তুই হাসিমুখে ঘরে ঢুকেছিস। তোর হাসিমুখ দেখে হাসলাম রে মা। আজ তোর মনটা খুশি কেন?
আজ ভিসা হয়েছে। ভিসা নিয়ে একটা দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল– দেয় কি দেয় না। সেই দুঃশ্চিন্তা দূর হয়েছে। এখন টিকিট কাটব।
আলহামদুলিল্লাহ। আয় আমার সঙ্গে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়।
থাক মা।
থাকবে কেন, আয়।
আমি অফিসের কাপড় পরে আছি। তেমন পরিস্কার নেই।
আমি পরিষ্কার শাড়ি দিচ্ছি। আয় তো মা। এখন থেকে বুঝলি মা, প্রতি পদে পদে আল্লাহর কাছে শোকরানা আদায় করে এগুবি দেখবি কোনো সমস্যা হবে না।
দিলশাদকে তার মা’র সঙ্গে নামাজ পড়তে হলো। অনেকদিন পর নামাজে দাঁড়িয়ে তার লজ্জা লজ্জা করছিল। তার কেবলি মনে হচ্ছে এই বুঝি ভুল করবে। রুকুতে গিয়ে সিজদার দোয়া পড়ে ফেলবে।