কবে পাঠাবেন?
কাল-পরশুর মধ্যেই পাঠাব।
কাগজপত্র পৌঁছতে পৌঁছতেই তো একমাস লাগবে।
না, তা লাগবে না। ফ্যাক্স চালু হয়েছে। আমেরিকায় চিঠি যেতে পাঁচ-ছ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। আপনি কিন্তু কফি খাচ্ছেন না।
আমি তো আগেই বলেছি কফি খাব না।
তাহলে কি চা দেব? টি ব্যাগস আছে।
মা বিরক্ত গলায় বললেন, কিছুই দিতে হবে না। আমি আবার কবে আসব বলুন।
দিন পনের পরে আসুন।
আপনি বললেন কাগজপত্র যেতে লাগবে পাঁচ-ছ মিনিট। আমাকে পনের দিন পরে আসতে বলছেন কেন?
উনি তো আর সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেবেন না। তাছাড়া আরেকটা স্কেনিং-এর রিপোর্ট লাগবে।
ঠিক করে বলুন তো–আমার মেয়ের সমস্যাটা কি আপনারা ধরতে পারছেন না।
পারছি– মেনিনজিওমা, তবে ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না। মাঝে মাঝে মেনিনজিওমার গ্রোথ ইলিউসিভ হয়। ধরা দিতে চায় না।
ভালোমতো ধরার চেষ্টা করছেন না বলে ধরতে পারছেন না।
আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না মা ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে এত খারাপ ব্যবহার করছে কেন। এমনভাবে কথা বলছে যেন আমার অসুখটার জন্যে ডাক্তার সাহেবই দায়ী। এরকম ব্যবহার সাধারণত খুব পরিচিত মানুষের সঙ্গেই করা যায়। অপরিচিতের সঙ্গে করা যায় না। আমার ক্ষীণ সন্দেহ হলো, মা এই ডাক্তার সাহেবকে চেনেন। হয়তো ছোটবেলায় পরিচয় ছিল। হয়তো এই ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথা হয়েছিল, শেষটায় আর বিয়ে হয় নি। কিংবা কে জানে হয়তো প্রেম ছিল। বিবাহিত মেয়েদের সঙ্গে পুরনো প্রেমিকের দেখা হলে মেয়েরা চট করে রেগে যায়। মেজোখালার বেলা এটা আমি দেখেছি। মেজোখালার সঙ্গে মনসুর সাহেবের খুব প্রেম ছিল। এসব অবশ্যি আমার শোনা কথা, আমি তাদের প্রেম-ট্রেম দেখি নি। আমার জন্মের আগের ব্যাপার। মেজোখালার যখন অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হলো তখন তার একেবারে মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। এই কাঁদেন, এই হাসেন। তারপর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেললেন। যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা। সেই মনসুর সাহেবের সঙ্গে দেখা হলে এখন তিনি ফট করে রেগে যান। নানান ধরনের অপমানসূচক কথা বলতে চেষ্টা করেন। আড়ালে ডাকেন ছাগলা বাবা। একেবারে রামছাগলা।
.
আমরা ফিরছি রিকশায়। আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসার সময় মা কীভাবে কীভাবে একটা গাড়ি জোগাড় করেন। আজ জোগাড় করতে পারেন নি। সেই জন্যেই কি তার মন খানিকটা খারাপ? তাকে কেমন রাগী রাগী লাগছে। রিকশায় চড়তেই আমার বেশি ভালো লাগে। রিকশার হুড ফেলে মাথা একটু উপরের দিকে তুললেই মনে হয় আমি শূন্যে ভাসছি। কিন্তু মা কখনোই রিকশার হুড ফেলবে না। বাবার বেলা সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার। রিকশায় উঠেই বাবা বলবে–মাই ডিয়ার টিয়া পাখি, হুড ফেলে দে।
বাবার স্বভাবের সঙ্গে মা’র স্বভাবের কোনো মিল নেই। রিকশায় উঠে মা কোনো কথা বলবেন না, মূর্তির মতো বসে থাকবেন। আর বাবা সারাক্ষণ কথা বলবেন। দুটাই অবশ্যি অস্বাভাবিক। একেবারে কথা না বলাও যেমন অস্বাভাবিক আবার সারাক্ষণ কথা বলাও অস্বাভাবিক।
আমার সঙ্গে বাবার একটা মিল হলো– বাবাও রিকশায় চড়তে খুব ভালোবাসেন। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ এসে বলবেন, মাই ডিয়ার টিয়া পাখি, রিকশায় করে খানিকক্ষণ ঘুরবি নাকি? মা গেছে তোর মেজোখালার বাসায়। ঘণ্টা দুইয়ের আগে ফিরতে পারবে না। তার আগেই আমরা ফিরে আসব এবং আমরা আমাদের গোপন অ্যাডভেঞ্চারের কথা কাউকে কিছু বলব না। যাবি? আমি খুশি খুশি গলায় বললাম, যাব। বাবা বললেন–
টিং টিং টিটিং টিং।
রেবা রেবা লিং লিং।।
এটা হলো তাঁর চায়নিজ গান। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কিছু গান আছে। আরবি ভাষায় তার গানটা হলো
আহলান আহ আবু।
কাহলান কাহ কাবু৷।
চায়নিজ গানটাই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। যখন তখন গুন গুন করেন।
বাবার সঙ্গে রিকশায় ঘোরার আনন্দের কোনো তুলনা নেই। কত মজার মজার কথা যে বাবা রিকশায় যেতে যেতে বলেন! হাসির কথা, জ্ঞানের কথা। কত রকম ধাঁধা, কত রকম অংক। একবার বাবা বললেন, টিয়া পাখি, দেখি তোর বুদ্ধি কেমন। কঠিন একটা ধাঁধা দিচ্ছি। হুট করে উত্তর দিতে হবে না। ভেবে-টেবে বলবি। ব্যাপারটা হলো শিকল নিয়ে। শিকল দি চেইন। সবাই চায় চেইন থেকে মুক্তি। চেইন খুলে যাওয়া মানে মুক্তি, আনন্দ। শুধু একটি ক্ষেত্রেই চেইন খুলে যাওয়া মানে বন্ধন। আটকা পড়ে যাওয়া। বল তো দেখি কোন ক্ষেত্রে?
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, রিকশার ক্ষেত্রে। রিকশার চেইন খুলে যাওয়া মানে রিকশা বন্ধ।
বাবা হৃষ্ট গলায় বললেন, তোর অসম্ভব বুদ্ধি তো রে মা। রানি ভিক্টোরিয়ার বুদ্ধিও তোর চেয়ে কম ছিল বলে আমার ধারণা। তুই বুদ্ধি পেয়েছিস তোর মা’র কাছ থেকে। আমার কাছ থেকে বুদ্ধি পেলে তোর সর্বনাশ হয়ে যেত।
আমি বললাম, তোমার বুদ্ধি কি কম নাকি বাবা?
কম মানে? আমার বুদ্ধি হচ্ছে সর্বনিম্ন পর্যায়ের। প্রায় চতুষ্পদীয় গোত্রের।
বাবাকে আমার খুব বুদ্ধিমান মনে হয়। একধরনের মানুষ আছে যারা নিজেদের অন্যের কাছে বোকা হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসে। বাবা সে ধরনের। মানুষের এই অদ্ভুত স্বভাবের কারণ কী কে জানে! ইচ্ছে করে বাবা অন্যের সামনে বোকামি সব কাণ্ডকারখানা করে বসেন। যেমন ধরা যাক– মার কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছেন। তাদের চা দেয়া হয়েছে। তারা চা খাচ্ছেন। গল্পগুজব করছেন। হাসাহাসি করছেন। তখন বাবা হুট করে ঘরে ঢুকবেন। তাঁর গায়ে থাকবে ময়লা একটা গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। সেই লুঙ্গি প্রায় হাঁটুর কাছে উঠে এসেছে। তিনি ঘরে ঢুকে খুবই বিব্রত হওয়ার ভঙ্গি করবেন। মা অস্বস্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করবেন, কী ব্যাপার? বাবা আমতা আমতা করে বলবেন– দিলশাদ, খুব খিদে লেগেছে। আমাকে একটা ডিম ভেজে দাও তো, পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ঝাল করে।