সাজ্জাদের কাপড় ব্যবসায়ী ধনী মামার কাছেও দিলশাদ গিয়েছিল। তিনিও আনুশকার মতোই গভীর আগ্রহ নিয়ে সবকিছু শুনলেন। অনেকবার আহা আহা করলেন। কোন ডাক্তার দেখছে এসব জানলেন, তারপর বললেন– টিউমারের সবচে ভালো চিকিৎসা কী জানো মা? সবচে ভালো চিকিৎসা হলো হোমিওপ্যাথি। ঠিকমতো তিনটা ডোজ পড়লে আর দেখতে হবে না। আমার কাছে একজনের ঠিকানা আছে। লালবাগে বসে গোলাম সারোয়ার। তার কাছে যাও– আমার নাম বলল। সে দেখুক।
দিলশাদ বলল, ওকে বাইরে নিয়ে যাবার আমি সব ব্যবস্থা শেষ করেছি। আমি আপনার কাছে ধার চাইতে এসেছি। লাখখানিক টাকা আপনি আমাকে দিন।
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি মা? এক লাখ টাকা আমি ধার দেব কীভাবে?
আপনি পারবেন। আপনাকে টাকাটা আমি ফেরত দেব। ইন্টারেস্টসহ দেব। ব্যাংক যে হারে ইন্টারেস্ট দেয় সে হারে দেব।
ভদ্রলোক চোখ-মুখ শুকনা করে বললেন, তুমি তো মা আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছ। আমাকে সুদের লোভ দেখাচ্ছ। আমি কি সুদের কারবার করি? এইরকম নোংরা কথা তুমি কীভাবে বলো?
বেশ তো, আপনি সুদ নেবেন না। আসলটাই আমি আপনাকে ফেরত দেব।
আসল আমি পাব কই? এক লাখ টাকা তো খেলা কথা না। এতগুলি টাকা কোন সাহসে তুমি ধার চাও তাও তো বুঝি না।
দিলশাদ চলে এসেছে। আসার পথে রিকশায় সে কাঁদছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার, সে যে কাঁদছিল তা সে নিজে বুঝতে পারে নি। রাস্তার লোকজনদের অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে নিজের গালে হাত দিয়ে দেখে গাল ভেজা।
মানুষের অনেক বড় বড় স্বপ্ন থাকে। দিলশাদের এখন কোনো বড় স্বপ্ন নেই। তার সব স্বপ্নই ছোট ছোট স্বপ্ন। একসময় সে খুব স্বপ্ন দেখত। তার বারান্দাটা সে স্বপ্ন দেখার জন্যেই সাজিয়েছিল। এই বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে নানা কিছু ভাবতে তার ভালো লাগত। বারান্দা আগের মতোই আছে। সে বদলে গেছে। এখন সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে বারান্দায় এসে বসে। অপেক্ষা করে। স্বপ্নের জন্যে অপেক্ষা করে না, ঘুমের জন্যে অপেক্ষা করে।
অপেক্ষা করতে করতে দিলশাদ একসময় বারান্দাতেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার সারা গায়ে মশা ভন ভন করতে লাগল। সে কিছুই টের পেল না।
আজ ভিসা হলো
আজ ভিসা হলো। সবচে’ কঠিন অংশটাই বোধহয় সবচে’ সহজে হলো। ভিসা অফিসার আমেরিকান। তাঁর চোখমুখ কঠিন। ভুরু সবসময় কুঁচকানো। কিন্তু তিনি দিলশাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। চমৎকার বাংলায় বললেন, বিকাল তিনটার পর এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন।
দিলশাদ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ভিসা কি হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে।
স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ভিসা অফিসার আবারো হাসলেন। সেই হাসি দেখে দিলশাদের চোখ ভিজে ওঠার উপক্রম হলো। কিছুদিন হলো এটা হয়েছে। কেউ মমতা নিয়ে কিছু বললেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সেদিন অফিসে তার বস রহমান সাহেব তার কামরায় ডেকে পাঠালেন। দিলশাদ ভাবল কঠিন কিছু কথাবার্তা তাকে শুনতে হবে। সে দিনের পর দিন অফিস কামাই করছে। ছুটি নিচ্ছে না। ছুটি জমা করে রাখছে। কতদিন আমেরিকা থাকতে হয় কে জানে। সে রহমান সাহেবের ঘরে ঢুকল ভয়ে ভয়ে। প্রায় ফিস ফিস করে বলল, স্যার ডেকেছেন?
রহমান সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যা, বসুন। দিলশাদ ভয়ে ভয়ে বসল। রহমান সাহেব বললেন, আপনাকে কোনো কাজে ডাকি নি। আমার সাথে কফি খাওয়ার জন্য ডেকেছি। আপনি সারাক্ষণ এত টেনশনের ভেতর দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন দেখে মায়া লাগে। এত চিন্তিত হবেন না। যা হবার হবে। নিন, কফি খান আর শুনুন। আপনার মেয়েকে নিয়ে যদি কোথাও যাবার দরকার হয় আপনি অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে যাবেন। আমি ট্রান্সপোর্ট সেকশানকে বলে দিয়েছি। অফিস টাইমের বাইরেও যদি গাড়ি লাগে, আমাকে বলবেন। আমার ড্রাইভার আছে, গাড়ি পাঠিয়ে দেব।
দিলশাদ বলল, থ্যাংক য়্যু স্যার। বলতে বলতেই সে লক্ষ করল, তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। সে নিশ্চিত, রহমান সাহেব আর একটা কোনো মমতার কথা বললে সে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলবে। ভাগ্যিস তিনি আর কোনো কথা বলেন নি। গম্ভীর মুখে কফির কাপে চুমুক দিয়েছেন। সেও কফি খেয়েছে একবারও তার দিকে না তাকিয়ে।
আজ আমেরিকান অ্যাম্বেসিতে সে এসেছে অফিসের গাড়ি নিয়ে। গাড়ি ছাড়া উপায় কী? নাতাশাকে আনতে হয়েছে।
নাতাশা এখন ওয়েটিংরুমে তার বাবার কাঁধে হেলান দিয়ে বসে আছে। নাতাশাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে বরং কৌতূহলী হয়ে ভিসাপ্রার্থীদের শুকনো মুখ দেখছে। কিন্তু সাজ্জাদকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। দিলশাদ সামনে এসে দাঁড়াতেই সাজ্জাদ বলল, ভিসা হয়েছে?
দিলশাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হুঁ।
আমাকেও দিয়েছে?
হুঁ।
থ্যাংক গড।
বিকেল তিনটার সময় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেতে বলল।
দিলশাদ হাত ধরে মেয়েকে তুলল।
নাতাশা বলল, তুমি শুধু আমার হাতটা ধর মা। আমি নিজে নিজে হাঁটতে পারব।
নাতাশা হাঁটতে পারছিল না। এলোমেলো পা ফেলছে। ভিসাপ্রার্থীরা সবাই এখন তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাদের চোখে করুণা। নাতাশার খুব লজ্জা লাগছে। মানুষের করুণা গ্রহণ করার মতো লজ্জা আর কিছুতেই নেই।
সাজ্জাদের ভিসার জন্য অ্যাপ্লাই করার কোনোরকম ইচ্ছা দিলশাদের ছিল না। দুজনের যাবার টাকাই জোগাড় হচ্ছে না, ততীয় জন কীভাবে যাবে। সাজ্জাদ করুণ গলায় বলেছে– আমি যাব না, শুধু ভিসাটা করিয়ে রাখি।