দিলশাদ বলল, ঘুম পাচ্ছে নাতাশা?
নাতাশার ঘুম পাচ্ছে না, তবু সে বলল, হ্যাঁ।
যা, শুয়ে পড়।
তুমি ঘুমুবে না?
আমি আরেকবার গোসল করব। আমার খুব গরম লাগছে।
দিলশাদ আবার দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করল। তার এত ক্লান্তি লাগছিল মনে হচ্ছিল গায়ে পানি ঢালতে ঢালতে সে ঘুমিয়ে পড়বে। শরীর বেশি ক্লান্ত থাকলে ঘুমের খুব অসুবিধা হয়। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম চলে যায়।
দিলশাদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দুটা রিলাক্সেন খেল। তার সঙ্গে একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। এই দুয়ের কম্বিনেশন ঘুমের জন্যে ভালো। রিলাক্সেন ট্যাবলেটের নিয়ম হলো খাওয়ার পর আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ঝিমুনির মতো শুরু হলে বিছানায় যেতে হয়।
দিলশাদ ভেতরের বারান্দার পাটিতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। ঝিমুনি আসার জন্যে অপেক্ষা করছে। কাল সারাদিনে অনেকগুলি কাজ করতে হবে। কোনটার পর কোনটা করা হবে একটু গুছিয়ে নেয়া দরকার।
১. আমেরিকান অ্যাম্বেসি থেকে ভিসা ফরম আনতে হবে।
২. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটা চিঠি বের করতে হবে। চিঠির বিষয়বস্তু হলো- নাতাশার অপারেশন দেশে হওয়া সম্ভব না বলে তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এই চিঠির জন্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অনেক আগেই জমা দেয়া হয়েছে। এখন হঠাৎ করে তারা চাচ্ছে মেডিকেল বোর্ডের মতামত। চারজনের একটা মেডিকেল বোর্ড লাগবে। নাতাশার ডাক্তার বলেছেন মেডিকেল বোর্ডের মতামত ছাড়াই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি বের করার ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন।
৩. ফরেন কারেন্সি নেয়ার অনুমতির জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেতে হবে। তাদের কী সব ফরম-টরম পূরণ করতে হবে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি ছাড়া ব্যাংকে গিয়ে লাভ হবে না।
৪. বিমানের অফিসে যেতে হবে। গুরুতর অসুস্থ রোগী নিতে হলে কী সব পারমিশনের ব্যাপার আছে। এইসব ছোটখাটো সমস্যা। দিলশাদ জানে এই জাতীয় সমস্যার সমাধান হয়। ছোটাছুটি করলেই হয়। বড় সমস্যা টাকার সমস্যা। দিলশাদ টাকা এখনো জোগাড় করতে পারে নি। বড় দুলাভাই এখনো টাকা দেন নি। তাকে পাওয়াই যাচ্ছে না। অফিসে নাকি কিছুদিন হলো কম আসছেন। কাল একবার তার নতুন অ্যাপার্টমেন্টে যেতে হবে। অফিস থেকে অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা নিয়ে রাত করে উপস্থিত হতে হবে।
অনেক যন্ত্রণা, অনেক ছোটাছুটি করে মাত্র তিন লাখ টাকা জোগাড় হয়েছে। সেই তিন লাখের এক লাখ চলে যাবে টিকিটে। দশ হাজার ইউএস ডলার আগেই হাসপাতালে জমা করতে হবে। নয়তো রোগী হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করাবে না। প্রায় চার লাখ টাকা। কোত্থেকে জোগাড় হবে কে জানে! পরিচিত এমন কেউ নেই যার কাছে দিলশাদ যায় নি।
শুধু পরিচিত না, ভাসাভাসাভাবে পরিচিতদের কাছেও সে গিয়েছে। যেমন আনুশকার কাছে গেল। কলেজে একসঙ্গে পড়েছে, খুব হাই টাইপের মেয়ে। নিজে গাড়ি চালিয়ে আসত। তার জন্মদিনে সে ক্লাসের সব মেয়েকে রিভারক্রজে নিয়ে গিয়েছিল। বিশাল এক জাহাজে করে ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাওয়া, চাঁদপুর থেকে ফিরে আসা। গান-বাজনা, ম্যাজিক কত কিছুর ব্যবস্থা যে ছিল। খুঁজে খুঁজে সেই মেয়েকে সে বের করল। বারিধারায় প্রাসাদের মতো বাড়িতে থাকে। গেটে মিলিটারিদের মতো পোশাক পরা দারোয়ান। ভেতরে ঢোকাই মুশকিল। কেন আসা হয়েছে, কী দরকার, কী নাম সব কাগজে লিখে পাঠাতে হবে। মেম সাহেব যদি সেই কাগজ দেখে সেখানে নিজের নাম সই করে দেন তবেই বাইরের লোক ঢুকতে পারবে। প্রায় একঘণ্টার মতো বসে থেকে দিলশাদ যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হলো তাকে ডাকা হবে না, তখনি ডাক পড়ল। সে খুবই আশ্চর্য হলো যে, আনুশকা তাকে চিনতে পারল। আনুশকা হাসিমুখে বলল, আরে তুমি? নাম দেখে চিনতে পারি নি। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছি, তাই না? লং ডিসটেন্ট কল রিসিভ করছিলাম। এখন বলো তো কী ব্যাপার। সামাজিক, সাক্ষাতের জন্যে নিশ্চয়ই আস নি।
দিলশাদ অতি দ্রুত তার সমস্যার কথা বলল। তার নিজেকে ভিক্ষুকের মতো লাগছিল, তারপরেও সে কথা শেষ করল। একটা ব্যাপার তার ভালো লাগল– আনুশকা ঘটনাটা মন দিয়ে শুনল। অতি বড়লোকরা কোনো কিছুই মন দিয়ে শুনে না। তারা অল্পতেই অধৈর্য হয়ে পড়ে। এই মেয়ে অধৈর্য হচ্ছে না বা হলেও প্রকাশ করছে না। দিলশাদ অনেক কষ্টে হাসি হাসি মুখ করে বলল, এখন আমি পরিচিত অপরিচিত সবার কাছে ধার চেয়ে বেড়াচ্ছি। নিজেও লজ্জিত হচ্ছি, যার কাছে চাচ্ছি তাকেও লজ্জায় ফেলছি।
আনুশকা বলল, না, লজ্জার কী আছে! তুমি কি কিছু খাবে, চা বা কফি?
না। আমি এখন উঠব।
ভরদুপুরে শুধু-মুখে যাবে এটা কেমন কথা? সরবত করে দি?
কিছু লাগবে না।
আনুশকা হাসিমুখে বলল, তা কি হয়? বসো একটু।
দিলশাদকে সরবত এবং পেস্ট্রি খেতে হলো। আনুশকা তার হাতে মুখবন্ধ একটা খাম দিয়ে বলল, আমার পক্ষে যা সম্ভব তোমাকে দিলাম। এটা তোমাকে ফেরত দিতে হবে না।
দিলশাদ রিকশায় উঠে খামের মুখ খুলল। মাত্র একটা চকচকে পাঁচশ টাকার নোট খামের ভেতর ভরা। আনুশকা তাকে ভিক্ষা হিসেবেই পাঁচশ’ টাকা দিয়েছে।
এই লজ্জা, এই অপমান কি কোনোদিন দূর হবে? কোনোদিন কি দিলশাদ আনুশকার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে?
রিকশায় যেতে যেতে দিলশাদ ঠিক করল অপারেশনের পর নাতাশা যখন সুস্থ হয়ে যাবে তখন তাকে নিয়ে ঐ বাড়িতে আবার যাবে। সঙ্গে থাকবে ফুলের তোড়া আর দামি কিছু উপহার। দিলশাদ বলবে, আনুশকা, আমার মেয়েটা ভালো হয়ে গেছে। তোমাকে মেয়েটা দেখাতে আনলাম। ওর নাম নাতাশা। তোমার টাকাটা আমার দুঃসময়ে খুব কাজ দিয়েছে। টাকাটা ফেরত দিতে এসেছি। সঙ্গে সামান্য উপহারও এনেছি। খুব খুশি হব যদি উপহারটাও নাও।