BANGLA
The fire from Bangladesh
তৃষ্ণায় সাজ্জাদের শরীর এখন কাঁপছে। তার কাছে মনে হচ্ছে কোনো নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে মদ্যপান করার সুযোগের বিনিময়ে সে এখন সবকিছুই দিয়ে দিতে পারে। তার আত্মাও বন্ধক রাখা যেতে পারে। আত্মা বন্ধক রাখার লোক মেসিফস্টোফিলিস কাব্যে পাওয়া যায়, বাস্তবে পাওয়া যায় না। বাস্তবের মানুষ আত্মা সম্পর্কে খুব আগ্রহী, তবে আত্মার কেনা-বেচায় আগ্রহী না। আগ্রহী কোনো মানুষকে পাওয়া গেলে সে তার আত্মা বিক্রি করে দিত। আত্মাবিহীন মানুষ হবারও নিশ্চিয়ই অনেক মজা আছে।
.
দিলশাদ নিঃশব্দে রাতের খাওয়া শেষ করল। তার যে এত খিদে পেয়েছিল সে আগে বুঝতে পারে নি। ঘন ডালটা খেতে এত ভালো হয়েছে! ডাল থাকলে আরো কিছু ভাত খাওয়া যেত।
ফুলির মা বলল, চা দিমু আম্মা?
দিলশাদ বলল, দাও! তোমার পান আছে না? সেখান থেকে আমাকে একটু পান দিও। পান খেতে ইচ্ছা করছে।
দিলশাদ বারান্দার দিকে রওনা হলো। নাতাশার ঘরের ভেতর দিয়ে যাবার সময় লক্ষ করল নাতাশা এই গরমে চাঁদর গায়ে শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ, তবে দিলশাদ পুরোপুরি নিশ্চিত নাতাশা জেগে আছে। সাজ্জাদের সঙ্গে তার কথাবার্তা কী হয়েছে সবই শুনেছে। সময় বিশেষে এই মেয়েটার ঘাপটি মেরে থাকার অভ্যাস আছে।
দিলশাদ বলল, মা, জেগে আছিস? নাতাশা জবাব দিল না। দিলশাদ বারান্দায় চলে গেল। আজ খুব গুমট। কিছুক্ষণ আগে গোসল করা হয়েছে, এর মধ্যেই গা ঘেমে যাচ্ছে। শোবার আগে আবার গোসল করতে হবে। ফুলির মা চা দিয়ে গেছে। খেতে ভালো লাগছে। দিনের শেষ চা ফুলির মা ভালো বানায়। এক কাপ শেষ করার পর আরেক কাপ খেতে ইচ্ছা করে।
ফুলির মা, নাতাশা রাতে দুধ খেয়েছে?
জে খাইছে।
সবটা খেয়েছে?
তলার মধ্যে অল্প একটু ছেল। আফার বমি আসতে ছেল, তখন চাচাজান। বলছেন, থাউক শেষ করনের প্রয়োজন নাই।
তোমার চাচাজান দুনিয়ার সবকিছু বেশি বোঝেন তো তাই বলেছেন— থাক প্রয়োজন নেই। এত বড় একটা অপারেশন হবে, অপারেশন সহ্য করার শক্তি লাগবে না? দুধ-টুধ না খেলে শক্তিটা আসবে কোত্থেকে? আকাশ থেকে?
কথা তো আম্মা ঠিকই বলছেন।
কাল তোমার চাচাজান আবার আসবে। ফোপরদালালি করতে চেষ্টা করবে। তখন কঠিন গলায় বলবে– আম্মার নিষেধ আছে। মনে থাকবে?
জে, মনে থাকব।
ভেতর থেকে নাতাশা ক্ষীণ গলায় ডাকল, মা! দিলশাদ তৎক্ষণাৎ উঠে গেল।
বাথরুমে যাব মা।
দিলশাদ হাত ধরে মেয়েকে বিছানা থেকে নামাল। ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেল। আবার ফিরিয়ে এনে বিছানায় বসিয়ে দিল। কোমল গলায় বলল, আজ মাথাব্যথা হয়েছিল মা?
নাতাশা হাসিমুখে হা-সূচক মাথা নাড়ল যেন মাথাব্যথা হওয়াটা মজার একটা ব্যাপার।
কবার হয়েছিল?
তিনবার।
খুব বেশি?
হুঁ।
ব্যথার সময় ওষুধ খেয়েছিলি?
হুঁ।
তাতে কি ব্যথা কমেছিল?
হুঁ।
রাতের দুধ নাকি পুরোটা খাস নি?
বমি আসছিল মা।
বমি এলেও খেতে হবে। না খেলে শরীরে শক্তি আসবে না।
তুমি পান খাচ্ছ নাকি মা?
হ্যাঁ।
চপচপ করে পান খাওয়া আমার এত ভালো লাগে। আমাকে একটু পান দাও তো, আমি খাব। তোমার চাবানো পান একটু দাও।
আমার মুখের পান খেতে হবে না। দাঁড়া তোকে সুন্দর করে পান বানিয়ে দিচ্ছি।
না, তোমার মুখ থেকে দাও। কিচ্ছু হবে না।
অন্যের মুখের পান খাবি? ঘেন্না লাগার কথা। তোর ঘেন্না লাগে না?
উঁহু।
দিলশাদ নিতান্ত অনিচ্ছায় মেয়েকে পান দিল। নাতাশা পান চিবুতে চিবুতে সুন্দর একটা অভিনয় করল, হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, বাবা কোথায় মা?
দিলশাদ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ও তার এক বন্ধুর বাড়িতে গেছে। কী নাকি দরকার। না গেলেই না। তুই কি এতক্ষণ ঘুমুচ্ছিলি?
হুঁ। বাবা আমাকে কিছু না বলে চলে গেল?
তুই ঘুমুচ্ছিলি বলে তোকে জাগায় নি।
রাতে ফিরে আসবে?
রাতে আর আসবে না। কাল সকালে চলে আসবে।
নাতাশা খুব ভয়ে ভয়ে ছিল হয়তো মা তার অভিনয় ধরে ফেলবে। মা’র যা বুদ্ধি! ধরে ফেলারই কথা। তবে খুব বুদ্ধিমান মানুষরাই সবচে বেশি বোকার মতো কাজ করে। নাতাশার ধারণা, বাবার সঙ্গে তার মা যে ঝগড়াটা করেছে তা নিতান্ত বোকা মেয়েরাই করবে। এবং এই যে সে মিথ্যা অভিনয় করছে শুধুমাত্র বোকা মায়েদেরই সেটা ধরতে পারার কথা না। একজন সাধারণ বুদ্ধির মা হলেও ধরে ফেলত। তার মা’র এত বুদ্ধি অথচ সামান্য ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। এটা খুবই আশ্চর্যের কথা।
অভিনয়টা করে নাতাশার ভালো লাগছে। বাবা-মা কেউ জানবে না তাদের কুৎসিত ঝগড়া সে শুনেছে। তারা স্বস্তি বোধ করবে। এটা আনন্দিত হবার মতোই ঘটনা।
তোর বাবার সঙ্গে তুই কি অনেক গল্প-টল্প করেছিস?
হুঁ।
কী নিয়ে গল্প হলো?
সাইনবোর্ডের গল্পটা আবার শুনলাম। পুরোটা শোনা হয় নি। অর্ধেকটা বাকি আছে।
সাইনবোর্ডের কোন গল্প?
ঐ যে বাবা আর তার বন্ধুরা মিলে তাদের শহরের সব সাইনবোর্ড এক রাতে পাল্টে দিল। ছেলে হয়ে জন্মানোর কত মজা, তাই না মা? তারা কত কিছু করতে পারে?
দিলশাদ ভুরু কুঁচকে বলল, তুই কি তোর বাবার ঐসব বানানো গল্প বিশ্বাস করে বসে আছিস?
বানানো গল্প?
অবশ্যই বানানো গল্প। কয়েকজন মিলে এক রাতে সব সাইনবোর্ড খুলে অন্যখানে লাগাল। সাইনবোর্ড খোলা এত সহজ?
মার কথায় নাতাশা একটু মন খারাপ করল। সে জানে তার বাবার এই গল্পগুলি সত্যি গল্প। কিছু কিছু অদ্ভুত মানুষ পৃথিবীতে থাকে। তার বাবা একজন অদ্ভুত মানুষ। অদ্ভুত কোনো কিছু যদি তার মা’র মধ্যে থাকত তাহলে তার মাও হয়তো বাবাকে পছন্দ করত। মা’র মধ্যে অদ্ভুত কিছু নেই।