দিলশাদ প্রায় অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, নাতাশার অসুখের খবর জানলে তুমি কী করতে? তোমার কি কিছু করার ক্ষমতা আছে? মেয়ের চিকিৎসার জন্যে এগার লাখ টাকা আমার দরকার। তুমি পারবে এগার লাখ টাকা জোগাড় করতে? কী হবে তোমাকে জানিয়ে? আমাকে ধন্যবাদ দাও যে তোমাকে জানাই নি। জানাই নি বলে নিশ্চিন্ত মনে এই কমাস মদ-ফদ খেয়ে ফুর্তি করতে পেরেছ। জানালে এই ফুর্তিও করতে পারতে না।Thave spared you the pain.
সাজ্জাদ টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, আমার খাওয়া হয়ে গেছে, তুমি ইচ্ছা করলে খেতে বসতে পার।
দিলশাদ ফুলির মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, টেবিল পরিষ্কার কর, আমি খাব না।
সাজ্জাদ বলল, আমার উপর রাগ করে খাওয়া বন্ধ করার কোনো মানে হয় না। তুমি বাচ্চা মেয়ে না। তুমি ভয়াবহ টেনশানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ তা বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি বলেই রাগ করছি না।
তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো না, প্লিজ। লোমার সঙ্গে আমার কথা বলতেও ইচ্ছা করে না। তুমি ছিলে না, আমি শান্তিতে ছিলাম।
এখন আমি কি খুব অশান্তি করছি?
হ্যাঁ করছ। অশান্তি যে করছ তুমি নিজেও সেটা ভালো করে জানো। আজ এই যে আমার এত সমস্যা তার মূলেও কিন্তু তুমি।
সাজ্জাদ বিস্মিত হয়ে বলল, আমি!
দিলশাদ সহজ স্বাভাবিক গলায় প্রায় কাটা কাটা ভঙ্গিতে বলল, হ্যাঁ তুমি। দুষ্টগ্রহের কথা বইপত্রে লেখা থাকে না? তুমি আমার জীবনের দুষ্টগ্রহ।
সাজ্জাদ তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলল, নাতাশা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে সেটাও আমার জন্যে?
অবশ্যই তোমার জন্যে। ওর অসুখ জেনেটিক অসুখ। তোমার জিন আমার জিন মিশ খায় নি বলেই নাতাশার জিনে এই গণ্ডগোল হয়েছে। আমার মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। সিগারেট ধরাবে না। খবরদার! কিছুক্ষণ আগে এসেছ, এর মধ্যেই বাসা ধোয়ায় ঢেকে ফেলেছ। নিঃশ্বাস ফেলার উপায় নেই।
সাজ্জাদ সিগারেট ধরাল না। হাতের সিগারেট প্যাকেটে রেখে দিল। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে হকচকিয়ে গিয়েছে। দিলশাদ এই পর্যায়ে যাবে সে ঠিক ভাবতে পারে নি।
ফুলির মা ঘরে নেই। তবে সে চলেও যায় নি। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। সাজ্জাদ দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ফুলির মা, আমি এক কাপ চা খাব।
দিলশাদ সাজ্জাদকে অবাক করে দিয়ে বলল, চা আমি বানিয়ে এনে দিচ্ছি। But do me a favour, চা খেয়ে অন্যকোথাও চলে যাও।
অন্যকোথাও চলে যাব?
দিলশাদ শান্ত গলায় বলল, নিজের উপর আমার এখন আর আগের মতো কন্ট্রোল নেই। রাগ সামলাতে পারি না। তুমি বাসায় থাকলে আমার রাতে ঘুম হবে। আমি ক্রমাগত তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব। নাতাশা শুনবে। সে কিছু বলবে কিন্তু কষ্ট পাবে। সে এমনিতেই অনেক কষ্ট পাচ্ছে, আমি আমার মেয়েকে আর কষ্ট দেব না।
সাজ্জাদ অবাক হয়ে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে রইল। দিলশাদ বলল, সকালে আমি অফিসে চলে যাই। নানান কাজে সারাদিন ঘুরি। এইসময় তুমি এসে তোমার মেয়েকে সঙ্গ দিও। তোমার মেয়ের তোমাকে দরকার। আমার তোমাকে দরকার নেই।
সত্যি চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ, চলে যেতে বলছি। তোমাকে দেখেই আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। দুপুরে আমি কিছু খাই নি। খিদেয় আমার শরীর ঝিমঝিম করছে। তুমি আশেপাশে থাকলে আমি ভাত নিয়েও বসতে পারব না।
আমি চলে গেলে ভাত খেতে পারবে?
হয়তো পারব।
আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি। চা লাগবে না। তুমি খাওয়া-দাওয়া কর।
আমি নটার দিকে অফিসে চলে যাই। তুমি নটার পর চলে এসো।
আচ্ছা।
সাজ্জাদ প্রায় হতবুদ্ধি হয়ে ঘর থেকে বের হলো। সে ভেবে পাচ্ছে না দুঃশ্চিন্তায় দুঃশ্চিন্তায় দিলশাদের মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে কিনা। তার আচার-আচরণ হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মতো। এই রোগ কখনো কমে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে।
রাস্তায় নেমেই সাজ্জাদ ঠোঁটে সিগারেট নিয়েছে কিন্তু ধরাবার কথা তার মনে নেই। সে হাঁটছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। কোথায় যাবে তাও ঠিক করা নেই। এত রাতে কারো বাসায় ওঠা যাবে না, উঠতে হবে হোটেলে। সস্তাদরের হোটেল কোন অঞ্চলে আছে তাও মনে পড়ছে না। টাকা-পয়সা সে সামান্যই সঙ্গে এনেছে। এই মুহূর্তে মেয়ের অসুখের চেয়েও দিলশাদের ব্যবহার তাকে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। রেল স্টেশনের দিকে চলে গেলে কেমন হয়? প্ল্যাটফরমে হাঁটাহাঁটি করে রাত পার করে দেয়া যায়। কিংবা সারারাত রাস্তায় হাঁটাও যেতে পারে। শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা। শহরটা গত বিশ বছরে কত বড় হয়েছে সেটা তাহলে আন্দাজ করা যেত। তাতে অবশ্যি খোলা ক্ষুর হাতে হাইজ্যাকারের মুখোমুখি হবার আশঙ্কা থাকে। থাকুক না, আজ রাতে কোনো কিছুই ভয়ঙ্কর বলে মনে হবে না। ভোলা ক্ষুর হাতের হাইজ্যাকারদের দেখা পাওয়াও হবে a welcome change, বরং ওদের সে বলতে পারে- বন্ধুরা, তোমাদের খুশি করার মতো অর্থ আমার কাছে নেই। যা আছে তা অতি সামান্য। সেটা তোমাদের দিয়ে দিচ্ছি। প্লাস একটা হাতঘড়ি। ঘড়িটা দামি। পুরনো হলেও দামি। বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া। তার বদলে আমাকে তোমাদের সঙ্গে নিয়ে চল– টু নাইট লেট আস বি ফ্রেন্ডস। চল আজ রাতে একসঙ্গে নেশা-টেশা করি। সস্তায় নেশা করার জায়গা নিশ্চয়ই তোমাদের জানা
আছে। বাংলা মদ এখন কী দরে বিক্রি হচ্ছে? হাঁড়ি কত? দামি বোতলে সুন্দর লেবেল সেঁটে এই জিনিস বিদেশে এক্সপোর্ট করলে বিদেশীরা বুঝত– আমরা কী জিনিস। বোতলের গায়ে টকটকে লাল অক্ষরে লেখা থাকবে বাংলা। ইংরেজি লেবেলেটা হবে এরকম