তখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছি। রেজাল্ট বেরুতে দু-তিন মাস দেরি। আমাদের কিছু করার নেই। সময় আর কাটছে না। কয়েক বন্ধু মিলে প্ল্যান করলাম, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ট্যুর দেব। সাইকেল ট্যুর। আমরা ছয় বন্ধু, সাইকেল জোগাড় হলো তিনটা। ট্যুর প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেল। কী করা যায় কিছুই বুঝতে পারছি না। একেকদিন একেকজনের মাথা থেকে একেক ধরনের আইডিয়া আসে। আইডিয়া নিয়া চিন্তা-ভাবনা করতে করতে সময় কেটে যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় মা। আমাদের এক বন্ধু ছিল– করিম। এফ, করিম।
বাবা, উনি এখন কোথায়?
জার্মানি চলে গিয়েছিল। সেখানেই নিখোঁজ হয়ে গেছে। কেউ কোনো খবর জানে না।
তোমার সেই বন্ধুর যা বুদ্ধি, আমার ধারণা, উনি বড় কিছু করেছেন।
করতে পারে। তবে ওর বুদ্ধির সবটাই ফাজলামি ধরনের। ফাজলামি ধরনের বুদ্ধি দিয়ে খুব বেশি কিছু করা যায় না মা।
তারপর কী হলো বাবা বললো।
এক রাতে করিম বলল, চল আমরা এক কাজ করি। শহরের মানুষগুলির পিলে চমকানোর ব্যবস্থা করি। আক্কেল গুড়ুম করে দি। আমি বললাম, কীভাবে করবি? করিম বলল, এমন কিছু করব যে শহরের লোকগুলির চোখ শুধু কপালে না, মাথার তালুতে উঠে যাবে। যেমন ধর, এক দোকানের সাইনবোর্ড অন্য দোকানে লাগিয়ে দেব। এক রাতের মধ্যে সব সাইনবোর্ড বদলে দেব। মিষ্টির দোকানে ঝুলবে ফার্মেসির সাইনবোর্ড। কাঠের দোকানে ইউনানি দাওয়াখানার সাইনবোর্ড। করিমের আইডিয়া আমাদের সবার যে পছন্দ হলো তা না। কিছুই করার নেই। বলেই আমরা রাজি হলাম। মফস্বল শহরে পাহারাদার-টার এমন থাকে না। রাতটাও ছিল শীতের রাত। সবাই গভীর ঘুমে। আমরা হাতুড়ি, পেরেক আর খুন্তি নিয়ে বের হলাম। তারপর শুরু করলাম সাইনবোর্ড বদলানো। কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব মজা পেয়ে গেলাম। রাত সাড়ে তিনটার মধ্যে সব সাইনবোর্ড পাল্টানো হয়ে গেল। আমরা খুশি মনে ঘুমুতে গেলাম। পরদিন সারা শহরে হৈচৈ পড়ে গেল। সবার মুখে মুখে সাইনবোর্ডের কথা। সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে কত রকম গবেষণা, কত থিওরি। মফস্বল শহরে তো আর উত্তেজনার মতো কিছু ঘটে না। সামান্য কিছু ঘটলেই তা নিয়ে তোলপাড় হয়ে যায়। আমরা কল্পনাও করি নি আমাদের সাইনবোর্ড পাল্টানোর ব্যাপারটা এত আলোড়ন তুলবে। আমরা চিন্তা করতে লাগলাম এর পর কী করা যায়। টিয়া পাখি, ঘুমিয়ে পড়েছিস?
নাতাশা জবাব দিল না। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সাজ্জাদ ভেতরের বারান্দায় চলে গেল। অনেকক্ষণ সিগারেট খাওয়া হয় না। গল্প বলে বলে মুখ শুকিয়ে গেছে। সাজ্জাদ বেতের চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গে কলিংবেল বাজল। তার নিজেরই দরজা খুলে দিতে ইচ্ছা করছে। সেটা সম্ভব হলো না। ফুলির মা ছুটে গেল। হড়বড় করে সে চাচাজানের আসার সংবাদ দিচ্ছে। দিলশাদকে না দেখেই সাজ্জাদ বুঝতে পারছে ফুলির মা’র উৎসাহ দিলশাদের ভেতর সংক্রমিত হলো না। সে শুধু জিজ্ঞেস করল– নাতাশা খেয়েছে? সাজ্জাদের মনে হলো, মানুষকে অগ্রাহ্য করার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে এই মহিলা জন্মেছে। তবু নিজের স্বামীকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা সম্ভব না। সে অবশ্যই বারান্দায় এসে জিজ্ঞেস করবে, কখন এসেছ? সাজ্জাদ অপেক্ষা করতে লাগল। দিলশাদ বারান্দায় এলো না। সে কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। তার শরীর ঘামে কুটকুট করছে। সে আজ অনেক সময় নিয়ে গোসল করবে এবং বাথরুমের নির্জনতায় কিছুক্ষণ কাঁদবে। আজ তার কেন জানি কান্না পাচ্ছে।
তাদের দেখা এবং কথা হলো খাবার টেবিলে। সাজ্জাদ লক্ষ করল দিলশাদকে খুব রোগা এবং অসুস্থ লাগছে। চোখের কোণে কালি পড়েছে। মেয়ের অসুখ নিয়ে সে অকুল সমুদ্রে পড়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। সাজ্জাদের খুব মায়া লাগল। কিছু অত্যন্ত কঠিন কথা বলবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। এখন মনে হচ্ছে কোনো কিছুই বলা ঠিক হবে না।
দিলশাদ শুকনো গলায় বলল, তুমি খেয়ে নাও। আমি এখন খাব না।
রাত তো কম হয় নি। এখন খাবে না তো কখন খাবে?
যখন খেতে ইচ্ছা করবে তখন খাব। আমার ব্যাপার নিয়ে তোমাকে অস্থির হতে হবে না।
অস্থির হচ্ছি না, শুধু জিজ্ঞেস করলাম।
জিজ্ঞেস করারও দরকার নেই। তোমাকে খেতে দেওয়া হয়েছে, তুমি খেয়ে নেবে।
সাজ্জাদ প্লেটে ভাত নিল। দিলশাদ এমন কঠিন আচরণ কেন করছে সে ঠিক বুঝতে পারছে না। বড় বিপর্যয়ের সময় মানুষ কাছাকাছি চলে আসে, সে দূরে চলে যাচ্ছে কেন?
ফুলির মা চিন্তিত মুখে পানির জগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দিলশাদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, জগ হাতে সঙ-এর মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? এত বড় টেবিলে জগ রাখার জায়গা পাচ্ছ না? জগ নামিয়ে রেখে বসার ঘরে তোমার চাচাজানের বিছানা করে দাও। আমার খাটের নিচে তোষক আছে, মশারি আছে। যাও সামনে থেকে। হা করে দাঁড়িয়ে থাকবে না।
সাজ্জাদ ডাল নিতে নিতে বলল, পৃথক বিছানা হচ্ছে?
হ্যাঁ হচ্ছে। কোনো অসুবিধা আছে?
না। অসুবিধা নেই। টিয়া পাখি ঘুমুচ্ছে, হৈচৈ করো না।
তুমি আমার এখানে থাকলে হৈচৈ হবে। চেঁচামেচি হবে। হৈচৈ ছাড়া বাস করতে চাইলে যেখান থেকে এসেছ সেখানে চলে যাও। জঙ্গলে চলে যাও।
সাজ্জাদ হতাশ গলায় বলল, তুমি অকারণে রাগ করছ, রাগ করার মতো কোনো অপরাধ আমি এখনো করি নি। বরং তুমি অপরাধ করেছ। নাতাশার অসুখের খবর আমাকে জানাও নি। আমাকে না জানানোর পেছনে তোমার লজিক কী তা আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোনো লজিক আছে। তুমি লজিক ছাড়া কোনো কাজ করবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে আমি সম্ভবত আমার অল্প বুদ্ধির কারণে তোমার লজিক ধরতে পারছি না। এখনি বা কেন হঠাৎ করে রেগে যাচ্ছ সেটাও বুঝতে পারছি না।