দিলশাদ তাকিয়ে আছে। সে ক্লান্ত গলায় বলল, তোমার এই অবস্থা!
হ্যাঁ রে দিলু, এই অবস্থা। বাইরে থেকে দেখে কেউ কিছু বুঝবে না। ঠাটবাট সবই আছে। তিনদিন আগে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে কার্পেট কিনলাম। এখনো টাকা দেয়া হয় নি। রোজ টেলিফোন করছে। একবার ভাবলাম বলি, আপনারা আপনাদের কার্পেট নিয়ে যান। শেষে ভাবলাম, ঠিক আছে, যাক কয়েকটা দিন। দরকার হলে গয়না বেচব। কী করা! গয়না তো আজকাল কেউ পরে না। লকারেই পড়ে থাকে। বিক্রি করলেই কী, আর না করলেই কী। তুই কি কিছু খেয়েছিস দিলু? না শুধু-মুখে বসে আছিস?
লেবুর সরবত খেয়েছি।
ভাত খাবি? ভাত খা। ওর এক বন্ধু রূপচান্দা শুঁটকি পাঠিয়েছে চিটাগাং থেকে। ঝাল ঝাল করে বেঁধেছি। খেয়ে যা।
না, কিছু খাব না। আজ উঠব।
তুই কি টাকার জন্যে এসেছিলি?
হ্যাঁ। দুলাভাই আজ আসতে বলেছিলেন।
কাল আয়। কাল এসে ওর সঙ্গে কথা বল। আমি ওকে বাসায় থাকতে বলে দেব। তাবে তোকে সত্যি কথা বলি–ওর পক্ষে সম্ভব না। ওর ভয়াবহ অবস্থা। তোর টাকা জোগাড় হয়েছে কেমন?
সামান্যই হয়েছে।
বড় দুলাভাই যে টাকাটা দেবেন বলেছেন, দিয়েছেন?
এখনো দেন নি।
টাকাটা নিয়ে নে। আপার সঙ্গে দুলাভাইয়ের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বড় . দুলাভাই আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছেন। এখন শুনছি বেশিরভাগ সময় সেখানেই থাকেন। হোটেল থেকে ভাত আনিয়ে খান। সম্পর্ক আরো খারাপ হবার আগেই টাকাটা নিয়ে নেয়া দরকার।
আপা, আমি আজ উঠি।
তুই বোধহয় আমার কথা বিশ্বাস করিস নি। তুই ভেবেছিস আমি বানিয়ে বানিয়ে অভাব-টভাবের কথা বললাম।
তা ভাবব কেন!
বিশ্বাস কর, আমি এক বর্ণ মিথ্যা বলি নি। পাপিয়া একটা মিউজিক্যাল ট্যুরে মালয়েশিয়া যাবে। ওর বাবাকে লিখল পাঁচশ ডলার পাঠাতে। ঘুরবে-টুরবে, কেনাকাটা করবে। ওর বাবা বলল, মালয়েশিয়ার কোনো দরকার নেই। মেয়েকে ঢাকায় চলে আসতে বলল। ওর পড়ার খরচ দিতে পারব কিনা তার নেই ঠিক। শেষপর্যন্ত অবশ্যি টাকা পাঠিয়েছে। কী করে পাঠিয়েছে সে-ই জানে। আমি ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি নি।
আপা, আজ উঠি?
উঠবি? দাঁড়া, তোকে কয়েকটা রূপচান্দা মাছের শুঁটকি দিয়ে দি।
শুঁটকি দিতে হবে না। তুমি তোমার ড্রাইভারকে বলো আমাকে একটু নামিয়ে দিতে। এত রাতে একা যেতে ভরসা হচ্ছে না।
ভরসা হলেও তোকে আমি একা ছাড়ব নাকি? দিলু, বড় দুলাভাইয়ের ব্যাপারে যেটা বললাম মনে রাখিস। ভুজুং-ভাজুং দিয়ে টাকাটা ম্যানেজ করে নে। কালই যাবি।
দেখি।
এখানে দেখাদেখির কিছুই নেই। প্রয়োজনটা আমাদের। ও, আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। পাপিয়ার বাবার এক ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে, টিভির কর্তা ব্যক্তি। তার সঙ্গে পাপিয়ার বাবার কথা হয়েছে। ওদের একটা ম্যাগাজিন। নাতাশাকে প্রজেক্ট করবে। নাতাশার সঙ্গে কথা-টথা বলবে। প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিল এটা বলে তার জন্যে সাহায্য চাওয়া হবে। লোকজন এমনিতে কিছু দিতে চায় না। কিন্তু টিভিতে কিছু প্রচার করলে হু হু করে টাকা আসতে থাকে। আমাদের কিছু করতে হবে না। শুধু ব্যাংকের একটা অ্যাকাউন্ট নাম্বার দেয়া থাকবে। টাকা সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়ে যাবে। নাতাশাকে টিভি স্টেশনে যেতেও হবে না। টিভি ক্রুরা বাসায় এসে রেকর্ড করবে।
দিলশাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এসবের কোনো দরকার নেই আপা।
দরকার নেই কেন? আমি তো কোনো অসুবিধা দেখছি না। আমাদের কার্যোদ্ধার দিয়ে হচ্ছে কথা।
নাতাশা মনে কষ্ট পাবে। এমনিতেই সে ভয়াবহ কষ্টের মধ্যে আছে। আমি সেই কষ্ট আর বাড়াতে চাই না।
ফট করে না বলিস না। ভেবে দেখ।
এর মধ্যে ভাবাভাবির কিছু নেই। আপা, আমি আজ যাচ্ছি।
আয়, আমিও তোর সঙ্গে যাই। তোর বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসি।
তোমাকে যেতে হবে না। তুমি উত্তরা থেকে ক্লান্ত হয়ে এসেছ। তুমি বিশ্রাম কর।
দিলরুবা দুটা রূপচান্দার শুঁটকি পলিথিনের ব্যাগে করে নিয়ে এলো। সঙ্গে একটা গল্পের বই। শরদিন্দুর ‘ঝিন্দের বন্দি’।
নাতাশার জন্যে পাপিয়া পাঠিয়েছে। বইটা ওকে দিয়ে দিস। কাল-পরশু একবার গিয়ে ওকে দেখে আসব।
দিলশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, আচ্ছা এসো।
তোকে একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলা হয় নি। আমাদের সামনের বাসায় যে ভাড়াটে থাকে– আরব বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় অফিসার। সে সেদিন হঠাৎ এসে আমাকে একটা দাওয়াতের কার্ড দিয়ে গেল। ওদের কী যেন অফিসিয়েল ফাংশান, যেতেই হবে…।
আপা, তোমার এই গল্প আরেকদিন এসে শুনব। আজ যাই।
.
সাজ্জাদ মেয়ের সঙ্গে গল্প করছে। গল্প করে আগের মতো আনন্দ পাচ্ছে না। নাতাশা তার দিকে তাকিয়ে আছে ঘুম ঘুম চোখে।
সাজ্জাদ একবার বলল, মা, ঘুম পাচ্ছে?
নাতাশা বলল, ঘুম পাচ্ছে না তো। অসুখের জন্যে আমার চোখ ছোট ছোট হয়ে গেছে। তুমি সাইনবোর্ডের গল্পটা আরেকবার বলল।
শোনা গল্প আবার শুনবি?
হুঁ।
নতুন অনেক গল্প আছে। সেগুলি শোন। জঙ্গলের গল্প।
না। তুমি গল্প বলার সময় আমার দিকে তাকিও না। আমার দিকে তাকালে তোমার মনে হবে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। তুমি আগের মতো মজা করে গল্প করতে পারবে না। বাবা, শুরু কর।
সাজ্জাদ চিন্তিত গলায় বলল, তোর মা এখনো আসছে না। এগারটার উপরে বাজে।
তোমার গল্প শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মা চলে আসবে। দেরি না করে তুমি শুরু কর তো বাবা।