ডাক্তার সাহেব আমাকে যদি চুপি চুপি ব্যাপারটা জানিয়ে দিতেন তাহলে আমার খারাপ লাগত না। কে জানে, হয়তো ভালোই লাগত। ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখতাম। সেই দাগ দেয়া তারিখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু ঠিক করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু কেউ ব্যাপারটা আমার মতো করে দেখছে না। সবাই ভাবছে, আমি খুব বাচ্চা একটা মেয়ে। মৃত্যু কী তা-ই আমি পরিষ্কার জানি না। আমাকে নানান ধরনের মিথ্যা কথা বলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখতে হবে। আমাকে ভুলানোর তাদের চেষ্টা এত হাস্যকর! আমার পেটের ভেতর হাসি গুড় গুড় করে ওঠে। কিন্তু আমি তাদের তা বুঝতে দেই না। আমি ভান করি যেন তাদের প্রতিটি বাক্য আমি বিশ্বাস করছি।
মা আমাকে গত মাসের ৯ তারিখে পিজির নিওরোসার্জন প্রফেসর ডা. ওসমানের কাছে নিয়ে গেলেন। মা’র সঙ্গে ভদ্রলোকের আগেও কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি এই প্রথম তাকে দেখছি। খুব ফর্সা ছোটখাটো ধরনের মানুষ। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। চশমার কাঁচ ভারি বলে চোখ দেখা যাচ্ছে না, তবে আমার মনে হলো দ্রলোকের চোখ সুন্দর। খুব সুন্দর।
আমার কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এই যেমন চোখ দেখছি না, তারপরেও মনে করে নিলাম চোখ সুন্দর। মাঝে মাঝে একটা গল্পের বই হাতে নিয়ে বইয়ের নাম, লেখকের নাম না পড়েই মনে হয়– বইটা খুব সুন্দর। হয়ও তাই। এই ডাক্তার সাহেবের চোখ নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে। আমি অপেক্ষা করছি কখন তিনি চোখ থেকে চশমা সরাবেন। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে একসময় তিনি চোখ থেকে চশমা সরাবেন। কিংবা চশমাটা আপনাতেই একটু নিচে নেমে যাবে। ডাক্তার সাহেব খুব মন দিয়ে কাগজপত্র দেখছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম, কাগজপত্র দেখতে দেখতে ভদ্রলোকের চেহারাটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল। তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। একবার মার দিকে, একবার আমার দিকে তাকাতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ খুব স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে লাগলেন। এখন তিনি আর কোনো কাগজই মন দিয়ে দেখছেন না, আবার আমার দিকেও তাকাচ্ছেন না। শুধু পাতা ওল্টাচ্ছেন। আমার মনে হলো তিনি নিজেই এখন নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছেন। তারপর হঠাৎ হাতের কাগজগুলি একপাশে সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন খুকি, তুমি কিছু খাবে না? কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কিছু?
আমি কিছু বলার আগেই মা বললেন, ও কিছু খাবে না। ওকে আপনি কেমন দেখলেন বলুন?
মা’র গলা খুব কঠিন শুনাল। যেন তিনি খুব বিরক্ত। এমনিতে মা’র গলার স্বর নরম ও আদুরে। শুধু বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় সেই স্বর কঠিন হয়ে যায়। এখন দেখছি এই ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সময়ও স্বর কঠিন হয়ে গেল। শুধু তাই না, তার ভুরু কুঁচকে গেল।
ডাক্তার সাহেব চোখ থেকে চশমা সরিয়ে এখন চশমার কাঁচ পরিষ্কার করছেন। আমি অবাক হয়ে ভদ্রলোকের চোখ দেখছি। আশ্চর্য, এত সুন্দর চোখ!
ডাক্তার সাহেব চুপ করে আছেন। মা আবারো বললেন, আমার মেয়ের অবস্থা কেমন দেখলেন বলুন?
ডাক্তার সাহেব শান্ত গলায় বললেন, ভালোই।
আমি লক্ষ করলাম তিনি শুধু ভালো বললেন না। ভালোর সঙ্গে একটা ‘ই’ যোগ করে দিলেন। ভালোটাকে করলেন ভালোই। যার মানে আসলে ভালো নয়।
মা বললেন, ভালোই বলতে কী বুঝাচ্ছেন?
অবস্থা যা ছিল তারচে’ খারাপ হয় নি। মনে হচ্ছে লোকালাইজড গ্রোথ। যাই হোক, আরেকটা রেডিও নিওক্লাইড ব্রেইন স্কেন করাতে হবে।
সেটা তো একবার করানো হয়েছে।
ঐ স্কেন করাতে টেকনিসিয়াম ডিটিপিএ ইনজেকশান দিতে হয়। রেডিওঅ্যাকটিভ মেটিরিয়েলের ইনজেকশান। আগেরবার ইনজেকশানে কিছু সমস্যা ছিল, স্কেনিং ভালো হয় নি।
মা কঠিন গলায় বললেন, এবার যে ভালো হবে তার নিশ্চয়তা কী?
এবারে আমি পাশে দাঁড়িয়ে থেকে করাব।
মা হ্যান্ডব্যাগ থেকে রুমাল বের করতে করতে বললেন, আপনারা শুধু টেস্টের পর টেস্ট করছেন। আজ এই টেস্ট, কাল ঐ টেস্ট। চিকিৎসা শুরু করছেন না। দয়া করে চিকিৎসা শুরু করুন। আর আপনারা যদি মনে করেন চিকিৎসা করার মতো বিদ্যাবুদ্ধি আপনাদের নেই তাহলে সেটাও পরিষ্কার করে বলুন। আমার মেয়েকে আমি বাইরে নিয়ে যাব। দেশের ডাক্তারদের উপর থেকে আমার বিশ্বাস চলে যাচ্ছে।
এ জাতীয় কথায় যে-কোনো ডাক্তারের রাগ হবার কথা। তিনি রাগ করলেন। তিনি তার অবিশ্বাস্য সুন্দর চোখে মার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন মা অবুঝ এক কিশোরী যার কথা ধরতে নেই।
আমার গাল ঘামছে, মা রুমাল দিয়ে গালের ঘাম মুছে দিচ্ছেন। মানুষের কপাল ঘামে, আমার ঘামে শুধু গাল। অসুখের পর এটা হয়েছে। আমি কাউকে বলি নি। অসুখের কথা কারো সঙ্গে বলতে আমার ভালো লাগে না। ডাক্তারের সঙ্গেও না।
ডাক্তার সাহেব চশমা চোখে পরে মা’র দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি কফি খাবেন?
মা বললেন, না।
এক কাপ কফি খান। আমিও আপনার সঙ্গে খাব।
ডাক্তার সাহেব আবারো আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, খুকি, তুমি কিছু খাবে?
আমি হাসিমুখে বললাম, হ্যাঁ।
কী খাবে? জুস?
উঁহু, আমিও আপনাদের মতো কফি খাব।
তিনি কফি আনার জন্যে কাউকে বললেন না। তাঁর ঘরেই কফিপটে কফি জ্বাল হচ্ছে। কফির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এতক্ষণ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল না। যেই কফি পট দেখলাম, ওমনি গন্ধ পাওয়া শুরু করলাম। ডাক্তার সাহেব নিজেই মগে করে কফি এনে দিলেন। বালতির মতো সাইজের মগ। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে বললেন, প্রফেসর এলেনা এডবার্গ নামে একজন বিখ্যাত নিওরোসার্জন আছেন– ফিলাডেলফিয়াতে থাকেন। তার সঙ্গে আমার খুব ভালো পরিচয় আছে। টরেন্টোর এক কনফারেন্সে প্রথম আলাপ হয়। ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের নিচে কিন্তু পৃথিবীজোড়া খ্যাতি। আপনার মেয়ের সব কাগজপত্র আমি তার কাছে পাঠিয়ে দেব। তার একটা মতামত নেব।