বালিশের নিচ থেকে আমি আমার অ্যালার্ম ঘড়ি বের করলাম। সময় দেখলাম। তিনটা পঁচিশ। ঘড়িটাও আমি জন্মদিনে পেয়েছি। বড়খালা দিয়েছেন। ঢাকনা দেওয়া একটা ঘড়ি। ঘড়িটার ঢাকনার রঙও লাল টুকটুকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, এবারের জন্মদিনে আমি সব লাল রঙের জিনিস পেয়েছি। নিজান। আমাকে কামিজ কিনে দিয়েছেন। সেটার রঙও লাল। আমার স্কুলের মেয়েরা আমাকে একটি চকলেট আর বড় রঙ পেন্সিলের বাক্স দিয়েছে। পেনসিল বক্সে দুটা লাল রঙের ঘোড়া আঁকা।
আমার জন্ম ৩রা বৈশাখ। আমার জন্মের পর পর দাদাজানের কাঁঠাল গাছ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি উড়ে গিয়েছিল। এই দৃশ্য আমি দেখি নি, কিন্তু আমার কল্পনা করতে খুব ভালো লাগে। প্রতি জন্মদিনের ভোরবেলায় আমার মনে হয়- আজ কোনো একটা গাছ থেকে একঝাক টিয়া পাখি আকাশে উড়বে।
এ বছর আমার জন্মদিন করার কথা ছিল না। মা বললেন, অসুখ-বিসুখের মধ্যে জন্মদিন ভালো লাগবে না। রোগ সারুক, তারপর আমরা দারুণ হৈচৈ করে জন্মদিন করব। বিরাট একটা পার্টি দেব। ঠিক আছে মা? আমি বললাম, আচ্ছা।
মানুষ যেরকম ভাবে সেরকম হয় না। জন্মদিনের দিন সকাল থেকে এত মানুষ আসা শুরু করল। উপহারে ঘর ভর্তি হয়ে গেল। মার মুখ থমথমে হয়ে গেল। মা চাপা গলায় নানিজানকে বললেন, তোমরা কি ভেবেছ এটা আমার মেয়ের শেষ জন্মদিন? তোমাদের কাউকে আমি আসতে বলি নি। কেন তোমরা এত কিছু নিয়ে এসেছ? তোমরা যা ভাবছ তা হবে না। আমি আমার মেয়ের একশ বছরের জন্মদিন করব। নানিজান হাসিমুখে বললেন, একশ বছরের জন্মদিন তুই করতে পারবি না। তুই এতদিন বাঁচবি না। অন্যরা করবে।
মা কাঁদতে শুরু করলেন। নানিজান মা’র পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, নাতুকে নিয়ে তুই অনেকদিনের জন্যে বিদেশে চলে যাবি, কতদিন তাকে দেখব না। কাজেই একটা উপলক্ষ ধরে আমরা এসেছি। তুই এত রাগ করছিস কেন? নাতুর মাথার টিউমারের চেয়ে বড় টিউমার তো তোর মাথায় হয়েছে রে। আমেরিকা থেকে তুইও একটা অপারেশন করিয়ে আসিস। নানিজান মাথা দুলিয়ে খুব হাসতে লাগলেন। মা হেসে ফেললেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল।
আমার নানিজান অসাধারণ একজন মহিলা। যখনি তাকে দেখি তখনি তিনি হাসছেন এবং এত মিষ্টি করে হাসছেন। যার অন্তর যত সুন্দর সে নাকি তত সুন্দর করে হাসে। যদি তাই হয় তাহলে নানিজানের মতো সুন্দর অন্তর আর কারো নেই।
তিনি এসেই বললেন, এই নাতু, শুয়ে থাকবি না তো। উঠে বোস। রোগী শুয়ে থাকলে রোগ বসে থাকে। আর রোগী উঠে বসলে রোগ শুয়ে পড়ে।
আমি উঠে বসলাম। নানিজান আমার পেছনে বালিশ দিয়ে দিলেন। তারপর শুরু করলেন হাসির এক গল্প। গল্প বলবেন কী, নিজেই হাসতে হাসতে বাঁচেন না। এক লাইন বলেন, বলেই হাসেন। আরো এক লাইন বলেন, আবারো হাসি। এমন হাসাহাসি শুরু হলো যে, কে বলবে এ বাড়িতে কোনো অসুখ-বিসুখ আছে! আমি অনেকদিন পর মাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখলাম। আর একটা জিনিস লক্ষ করলাম, একটু পর পর মা এসে নিজানকে ছুঁয়ে যাচ্ছেন। কখনো হাত ধরে বসে থাকেন, কখনো গায়ের সঙ্গে গা লাগিয়ে বসেন। একসময় নানিজান ধমকের মতো করে বললেন, তুই তো বড় যন্ত্রণা করছিস! শুধু গায়ের সঙ্গে গা ঘসাচ্ছিস। এমনিতেই গরমে মরে যাচ্ছি।
সামান্য কথা। এতেও আবার সবাই হাসতে শুরু করল। নিজান একটা হাসির বড় ঝাড়বাতি জ্বেলে চলে গেলেন। তিনি আরো কিছুক্ষণ থাকতেন, কিন্তু তাকে যেতেই হবে, কারণ নানাভাই বাসায়। তিনি না গেলে নানাভাই ভাত খাবেন না। রাগ করে বসে থাকবেন। নানাভাই আবার নানিজান পাশে না থাকলে ভাত খেতে পারেন না।
বিকেলে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার ক্লাসের মেয়েরা এলো। তাদের নিয়ে এলেন আমাদের অঙ্ক-মিস-শাহেদা আপা। স্কুলে আমাদের এই অঙ্ক-মিসের নাম হলো শুকনা বাঘিনী’। আমাদের স্কুলে দুজন বাঘিনী আছেন। একজন হলেন থলথলা বাঘিনী, অন্যজন শুকনা বাঘিনী। আমরা সবচে’ বেশি ভয় পাই শুকনা বাঘিনীকে। স্কুলের বারান্দা দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে দেখলে আমাদের পানির পিপাসা পেয়ে যায়। তিনি যে আমার জন্মদিনে চলে আসবেন আমি চিন্তাও করি নি। তাকে দেখে আগের অভ্যাস মতো ভয়ে আমার পানির পিপাসা পেয়ে গেল। তিনি আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়ে অবাক গলায় বললেন, মা রে, তোর এই অবস্থা কেন হলো? বলেই কাঁদতে শুরু করলেন। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যেরকম শব্দ করে কাঁদে সেরকম শব্দ করে কান্না। তারপর তিনি ছুটে বারান্দায় চলে গেলেন। বারান্দা থেকে তার কান্নার শব্দ শোনা যেতে লাগল।
বাইরে থেকে দেখে একটা মানুষ কেমন তা বোঝা আসলে খুব কঠিন। আমাদের শুকনা বাঘিনী আপা আসলেই বাঘিনী। দয়া-মায়ার ছিটেফোঁটাও তার মধ্যে নেই। আদর করে কাউকে তিনি কোনো কথা বলেছেন বলে কেউ শুনে নি। পরীক্ষার হলে নকল করে কোনো মেয়ে ধরা পড়লে অবশ্যই তিনি তাকে এক্সপেল করে দেবেন। কেঁদে চোখ গালিয়ে ফেললেও কোনো লাভ হবে না। তবে কারো অসুখ-বিসুখ হলে অন্যকথা। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন মনিকা একদিন ক্লাসে এলো জ্বর নিয়ে। বাঘিনী আপা অঙ্ক পড়াতে এসে টের পেলেন। কঠিন গলায় বললেন, কী রে, তোর চোখ লাল কেন? জ্বর-জারি নাকি?
মনিকা ভয়ে নীল হয়ে বলল, জি-না আপা।