আমি বললাম, ছোট ঘরে যাব না, পানি খাব নানিজান।
নানিজান পানি আনার জন্যে উঠতে যাচ্ছেন, মা বললেন, তুমি বসো তো মা, আমি পানি এনে দিচ্ছি। আর ঠিক তখন কলিংবেল বেজে উঠল। আমি নিশ্চিত বুঝলাম খারাপ খবরটা এসে গেছে। আমার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এত রাতে মা দরজা খুলতে গেলেন না। নানাভাই জেগে ছিলেন, তিনি উঠে দরজা খুললেন। মা গেলেন নানাভাইয়ের পিছু পিছু। মা’র সঙ্গে আমিও গেলাম।
বুড়ো মতো ভিখিরী ধরনের এক জ্বলোক দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। এত নিচু গলায় বললেন যে, কেউ কিছু বুঝতে পারল না। নানাভাই বিরক্ত গলায় বললেন, কী বলছেন জোরে বলুন। কিছু বুঝতে পারছি না। আপনার গলায় জোর নাই।
বুড়ো দ্রলোক তখন আমার ছোট মামার মৃত্যুসংবাদ দিলেন।
কতদিন আগের কথা, এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। কথা বলার সময় বুড়ো ভদ্রলোকের মুখ থেকে থুথু ছিটকে আসছিল। সেই থুথুর খানিকটা এসে তাঁর দাড়িতে লাগল। দাড়ির মাথায় শিশিরের মতো থুথুর বিন্দু চিকচিক করতে লাগল। সেই থুথু আমি এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন দেখতে পাব।
বেশিদিন অবশ্যি আমি বেঁচে থাকব না। আর খুব অল্পদিনই বাঁচব। এটা মা জানে না। আমি জানি। এবং খুব সম্ভব আমার ডাক্তার সাহেব জানেন। মা পুরোপুরি নিশ্চিত চিকিৎসা-টিকিৎসা করে আমাকে সুস্থ করে ফেলবে। তখন আমি আবার আগের মতো হয়ে ছোটাছুটি শুরু করব। আমার অপারেশনের ব্যবস্থা সব হয়ে গেছে। এখন শুধু টিকিট কেটে প্লেনে ওঠা। ও না, ভিসা এখনো হয় নি। ভিসা নিয়ে মা খুব চিন্তা করছে। আমেরিকান অ্যাম্বেসি নাকি কাউকে ভিসা দিচ্ছে না। ভিসার চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার চিন্তা। টাকা জোগাড় করার জন্যে মা প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেছে। তার মাথা এলোমেলো। সেদিন সন্ধ্যাবেলা শুনি গুন গুন করে আপন মনে গান গাইছেন– ‘খোল খোল দ্বার রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।
আমি অবাক হয়ে মাকে দেখছি। কারণ তাঁকে আমি এভাবে কখনো গান গাইতে শুনি নি। মা আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন। আমি বললাম, মা, তুমি সুন্দর গান গাও তো। মা আরো লজ্জা পেলেন। বিড়বিড় করে কী যেন বললেন। এতটা লজ্জা পাওয়ার মার কিছু ছিল না। ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে আমরা সবাই অস্বাভাবিক আচরণ করি। ছোট মামার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে বুড়ো ন্দ্রলোক যখন এলেন তখন আমার নানাভাইও খুব অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলেন। বুড়ো ভদ্রলোককে বললেন, শুধু-মুখে যাবেন না। পান খেয়ে যান।
বাড়িতে তখন ভয়ঙ্কর কান্নাকাটি চলছে। নানাভাই এর মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পান খোঁজাখুজি করছেন। আমি অবাক হয়ে নানাভাইয়ের কাণ্ড দেখছি। আমার ধারণা, সেদিন থেকেই নানাভাইয়ের মাথা কিছু কিছু খারাপ হতে শুরু করেছে। কেউ বুঝতে পারে নি। আমি কিন্তু বুঝেছি।
আমি অনেক কিছুই বুঝতে পারি। এই যে ঘুমের মধ্যে মনে হলো আজ খুব ভালো কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত, আসলেই তা ঘটবে। কেউ বাজি ধরতে চাইলে আমি বাজি ধরতাম, এবং নির্ঘাৎ বাজিতে জিততাম।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজার কলিংবেল বাজতে লাগল। সেই ভালো কিছুটা কি এক্ষুনি ঘটবে? বাবা কি এসেছেন? কিংবা বাবার কোনো চিঠি? আমার শরীর যেন কেমন কেমন করছে। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে আমি পড়ে যাব। বুয়া দরজা খুলতে এত দেরি করছে কেন?
আমাদের বুয়া সব কাজ ঝটপট করে, শুধু কলিংবেল বাজলে দরজা খুলতে দেরি করে। মনে হয় কলিংবেলের শব্দ অনেক পরে তার কানে যায়। শব্দের গতিবেগ যেন কত? স্কুলে পড়েছিলাম। এখন আর মনে পড়ছে না। আলোর গতিবেগ মনে আছে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে- শব্দের গতিবেগ হলো প্রতি সেকেন্ডে তিনশ বত্রিশ মিটার। এক ফুট সমান ৩০.৪৮ সেন্টিমিটার।
আবার কলিংবেল বাজছে। বুয়া এখন যাচ্ছে। এত আস্তে আস্তে পা ফেলছে, মনে হচ্ছে পায়ের তলায় কোনো ফোড়া-টোড়া হয়েছে। পা ফেলতে খুব কষ্ট।
দরজা খুলল। কার সঙ্গে যেন কথা হচ্ছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না। আবার দরজা বন্ধ হলো। আমি বললাম, কে এসেছিল? বুয়া বলল, কেউ না।
এটা কোনো জবাব হলো? কেউ না আবার কী? কেউ একজন তো নিশ্চয়ই এসেছে।
তুমি কার সঙ্গে কথা বললে?
উকিল সাবের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে। আমি বলছি জানি না।
জানি না বললে কেন? উকিল সাহেবের বাড়ির ঠিকানা তো তুমি জানো। আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের বকুল গাছওয়ালা বাড়িটা উকিল সাহেবের বাড়ি।
যার দরকার হে খুঁইজা বাইর করুক।
খোঁজ করে তো সে পাচ্ছে না। তুমিও তাকে বলছ না।
আমার অত ঠেকা নাই। কিছু খাইবেন আফা। শীতল পানি।
আমাদের বুয়া মাঝে মাঝে কঠিন শব্দ ব্যবহার করে। ঠাণ্ডা পানি বলে না, বলে শীতল পানি। দৈ বলে না, বলে দধি। রুই মাছকে বলে রুহিত মাছ।
আফা, শীতল পানি আনমু?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ালাম। আমার আসলেই পানির পিপাসা হচ্ছে। বুয়া উৎসাহের সঙ্গে শীতল পানি আনতে চলে গেল। এখন আর তার পায়ের তলায় ফোড়া নেই। সে প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে।
মা আমার পানি খাওয়ার জন্যে একটা ফ্রিজ কিনেছেন। সেই ফ্রিজ জন্মদিন উপলক্ষে আমাকে দেয়া হয়েছে। ছোট্ট লাল টুকটুকে একটা ফ্রিজ। মা’র টাকা পয়সার এত টানাটানি, এর মধ্যে ফ্রিজ কিনল কেন? আমাকে অনেকখানি খুশি করে দেওয়ার জন্যে? যাই হোক, আমাকে সেই ফ্রিজের পানি খাওয়ানোর ব্যাপারে বুয়ার খুব উৎসাহ।