খুব কঠিনও না। এখন তো ভিক্ষাই করছি। বাবা, তুমি বলো তোমার কাছে কত টাকা আছে। যা আছে সব তুমি আমাকে দিয়ে দাও। কত আছে তোমার সেভিংস অ্যাকাউন্টে?
হাদিউজ্জামান সাহেব মেয়ের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। মেয়ের উপর তার কোনো মমতা হচ্ছে না। রাগ লাগছে। বিপদ-আপদ মানুষের আসে। সেই বিপদ সামলাবার চেষ্টা করতে হয়। সাহসের সঙ্গে করতে হয়। মাথা নিচু করে বিপদ মোকাবেলা করা যায় না, মাথা উঁচু করে করতে হয়। তার উপর মেয়ের অবিশ্বাসও তাকে কষ্ট দিচ্ছে। বারবার জানতে চাচ্ছে ব্যাংকে কত আছে। আশ্চর্য!
সেভিংস অ্যাকাউন্টে তার আছে দুই লক্ষ তিন হাজার সাত শ’ তের টাকা। এটা গত মাসের হিসাব। ইন্টারেস্টে এক মাসে কিছু বেড়েছে। তিনি দিলশাদের নামে দুই লক্ষ টাকার একটা চেক কেটে রেখেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে কথা ছিল দুজনে মিলে চেকটা মেয়ের হাতে দিয়ে আসবেন। এতে মেয়ে অনেকটা সাহস পাবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিপদে অর্থ যে সাহস দেয় অন্য কিছু সেই সাহস দিতে পারে না।
হাদিউজ্জামান উঠলেন। আসরের নামাজের সময় হয়ে আসছে। অজু করা দরকার। তিনি দিলশাদকে বললেন, একটু বোস, আমি নামাজটা পড়ে আসি। বেশিক্ষণ লাগবে না।
দিলশাদ শুকনো মুখে বারান্দায় বসে রইল। ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাজ পড়ছে। নাতাশার জন্যে তার খারাপ লাগছে। সে ভয় পাবে কিন্তু ফুলির মাকে ডাকবে না। একা একা কষ্ট পাবে। দিলশাদ ঘড়ি দেখল। দুটা বাজে। ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে। বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। কোনো অলক্ষণ কি? ঘড়ি কেন বন্ধ হবে? সেদিন মাত্র নতুন ব্যাটারি কেনা হলো।
হাদিউজ্জামান সাহেব নামাজ শেষ করতে অনেক সময় নিলেন। তিনি বারান্দায় এলেন চেক হাতে নিয়ে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মেয়েটাকে এই টাকাগুলো দেয়ার তার ইচ্ছা ছিল। দেয়া হলো না। মনোয়ারা তার মেয়ের আনন্দিত মুখ দেখতে পেল না। এটা একদিকে ভালোই হয়েছে। মনোয়ারার জন্যে উচিত শাস্তি। কেন সে দুপুরে ফেরার কথা বলে এখনো ফিরছে না? তিনি না খেয়ে বসে আছেন। একা একা তিনি খেতে পারেন না। তার খাওয়ার সময় মনোয়ারাকে সামনে থাকতে হয়।
দিলু!
জি বাবা।
নে মা। এই চেকটা রাখ। দুই লাখ টাকার চেক। এখন ভাঙাবি না। ভাঙালে খরচ হয়ে যাবে। সেভিংস অ্যাকাউন্টের চেক, জমা দেবার আগে আমাকে বলবি। আমি ব্যাংক ম্যানেজারকে চিঠি দেব। আমার চিঠি ছাড়া এতগুলি টাকা তারা রিলিজ করবে না।
দিলশাদ চেক হাতে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ ভিজে আসছে। বাবা না হয়ে মা যদি চেকটা তাকে দিত তাহলে সে হয়তো চিৎকার করে কেঁদে একটা কাণ্ড করে বসত।
হাদিউজ্জামান সাহেব বললেন, সেভিংস অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে জানতে চাচ্ছিলি– দুই লক্ষ তিন হাজার সাতশ’ তের টাকা আছে। তিন লক্ষ টাকা ছিল, গ্রামের স্কুলে এক লক্ষ টাকা সাহায্য করেছি। ওরা একটা লাইব্রেরি বানিয়েছে। তখন তো আর জানতাম না তোর এতবড় বিপদ হবে।
দিলশাদের চোখ বেয়ে পানির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। হাদিউজ্জামান। সাহেব বললেন, বিপদে অস্থির হবি না। অস্থির হলে বিপদ কমে না। বিপদ বাড়ে। আরেকটা কথা তোকে বলি– টাকা-পয়সা যদি জোগাড় না হয় অস্থির হবি না। ভাববি এটাও আল্লাহর ইশারা। আল্লাহর ইশারা ছাড়া জগতে কিছু হয় না। তোর মেয়েকে আমার রোজ দেখতে যেতে ইচ্ছা করে। তোরা বাসা নিয়েছিস তিনতলায়। ডাক্তার আমাকে তিন ধাপ সিঁড়ি ভাঙতেও নিষেধ করেছে। ইচ্ছা করলেও যেতে পারি না। তোর মাকেও আমি তোর বাসায় যেতে নিষেধ করেছি। তার বিশ্রী কাঁদুনি স্বভাব আছে। সে নাতাশাকে দেখলেই এমন কান্নাকাটি শুরু করবে যে তোর মেয়ে ভয় পেয়ে যাবে। তার মনোবল যাবে ভেঙে। এই অবস্থায় মনোবল ভাঙা খুব খারাপ।
বাবা আমি যাই?
আচ্ছা মা, যাও।
যাই বলেও দিলশাদ দাঁড়িয়ে থাকে। তার ইচ্ছা করছে বাবাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। মনে হচ্ছে বাবাকে ছোঁয়ামাত্র বাবার ভেতর থেকে অনেকখানি সাহস তার ভেতর চলে আসবে। কিন্তু বাবার সঙ্গে তার দূরত্ব অনেক বেশি। হাজার ইচ্ছা করলেও বাবাকে সে ছুঁতে পারবে না, কিংবা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারবে না। হাদিউজ্জামান সাহেব দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যাই বলেও মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোরা সবসময় ইনডিসিশনে ভুগিস– এটা আমার অসহ্য লাগে।
দুপুরে ঘুমুচ্ছিলাম
দুপুরে ঘুমুচ্ছিলাম। ঘুমের মধ্যেই মনে হলো দারুণ একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। খুব : আনন্দময় কিছু। আমার এরকম প্রায়ই হয়। আমরা একবার নানিজনদের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। মা নানিজান দুজনে মিলে এমন গল্প শুরু করলেন, সাড়ে এগারটা বেজে গেল। নানিজান বললেন, এতরাতে বাসায় ফিরে কী করবি? থেকে যা। আমরা থেকে গেলাম। নানিজানদের বাড়িতে বিছানার খুব অভাব। আমি, নানিজান আর মা আমরা তিনজন এক বিছানায় শুয়েছি। বালিশে মাথা ছোঁয়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘুম চলে এলো। ঘুমের মধ্যে মনে হলো, আমাদের খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর কোনো সংবাদ নিয়ে কেউ একজন আসছে। আমার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখি, মা আর নানিজান তখনো মজা করে গল্প করছেন। খুব হাসাহাসি হচ্ছে। নানিজান বাচ্চামেয়েদের মতো মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছেন। আমাকে জেগে উঠতে দেখে নানিজান হাসিমুখে বললেন, কী রে নাতু, ছোট ঘর যাবি? নানিজান আমাকে ‘নাতু’ ডাকেন। নাতাশা নামটা নাকি তার কাছে অনেক লম্বা লাগে। ডাকতে গিয়ে দম ফুরিয়ে যায়।