.
হাদিউজ্জামান সাহেব বাসায় ছিলেন। বারান্দায় বেতের ইজিচেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছিলেন। তার বসার মধ্যে কেমন জবুথবু ভাব। সম্প্রতি দাড়ি রাখা ধরেছেন। গালভর্তি ধবধবে সাদা দাড়ি। সাদা দাড়ি মানুষের চেহারা কোমল করে, তাকে করে নি। তাঁর মধ্যে আলদা কাঠিন্য চলে এসেছে।
দিলশাদ রিকশা থেকে নেমেই বাবাকে দেখল। তিনিও মেয়েকে দেখলেন। মনে হলো তিনি ঠিক চিনতে পারছেন না। তিনি ভুরু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দিলশাদ বলল, কেমন আছ বাবা?
তিনি মাথা নাড়লেন। সেই মাথানাড়া থেকে ভালো-মন্দ কিছু বোঝা গেল না। দিলশাদ বলল, ভেবেছিলাম তোমাকে পাব না। শরীর ভালো আছে?
হুঁ।
বাইরে বসে আছ কেন? বৃষ্টি দেখছ?
হাদিউজ্জামান সাহেব জবাব দিলেন না। মেয়ের মুখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। দিলশাদ বলল, দুলাভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম, উনি বললেন, আজ বুধবার, আজ নাকি তোমাকে পাওয়া যাবে না। বুধবারে পীর সাহেবের সঙ্গে তোমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে।
আজ যাই নি, শরীরটা খারাপ।
শরীর খারাপ? কী হয়েছে?
সব মিলিয়ে খারাপ, আলাদা করে বলার কিছু না।
মা বাসায় আছে বাবা?
না। কার বিয়েতে যেন গেছে। দুপুর দুটার মধ্যে চলে আসার কথা। এখন সাড়ে চারটার মতো বাজে। এখনো আসছে না। বেকুব মেয়েছেলে। আসতে দেরি হবে বলে গেলেই হতো। দুটার মধ্যে চলে আসব বলার দরকার কী? কাজের মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। এক কাপ চা যে খাব সে উপায় নেই।
আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি। তুমি দুপুরের খাওয়া খেয়েছ?
হাদিউজ্জামান সাহেব জবাব দিলেন না। দুপুরের খাবার তিনি খান নি, স্ত্রীর উপর রাগ করেই খান নি। মেয়েকে তা বলতে ইচ্ছা করছে না।
দিলশাদ বলল, মা’র জন্যেই কি তুমি বারান্দায় বসে আছ?
হাদিউজ্জামান সাহেব এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। কথা এমনিতেই তিনি কম বলেন। ইদানীং কথা বলা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। নিজে তো কথা বলেনই না, অন্য কেউ কথা বললেও বিরক্ত হন।
দিলশাদ চা বানানোর জন্যে রান্নাঘরে চলে গেল। তার মা’র রান্নাঘর খুব গোছানো। একজন অন্ধও যদি রান্নাঘরে ঢুকে সে বলে দিতে পারবে কোথায় কী আছে। দিলশাদের ধারণা, তার মা’র রান্নাঘরের মতো পরিষ্কার ছিমছাম রান্নাঘর ঢাকা শহরে আর কারো নেই।
চা বানিয়ে দিলশাদ বারান্দায় চলে এলো। হাদিউজ্জামান সাহেব আগের মতোই বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তিনি মেয়ের হাত থেকে অনাগ্রহের সঙ্গে চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, নাতাশা কেমন আছে?
আগের মতোই আছে।
তোর মা’র কাছে শুনলাম ওকে বাইরে নিয়ে যাবার সবকিছু ফাঁইনাল হয়েছে।
হ্যাঁ।
ভিসা হয়েছে?
না।
মেয়ে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া তো বিরাট খরচান্ত ব্যাপার।
হ্যাঁ।
টাকা পয়সার ব্যবস্থা কী হয়েছে?
এর-তার কাছে চেয়ে-টেয়ে জোগাড় করছি।
ভিক্ষা?
দিলশাদ কঠিন গলায় বলল, ভিক্ষা না, ধার।
ধার শোধ করবি কীভাবে?
একটা ব্যবস্থা হবেই।
হাদিউজ্জামান সাহেব বিরক্তমুখে বললেন, ব্যবস্থা হবে বললেই তো আর ব্যবস্থা হয় না। তার জন্যে পরিকল্পনা থাকতে হয়। তোর পরিকল্পনাটা কী?
কোনো পরিকল্পনা নেই বাবা। ভাবার মতো সময় পাচ্ছি না। আমি যে কী পরিমাণে অশান্তিতে আছি তোমাকে বুঝাতে পারব না। রাতে ঘুমুতে পারি না। শেষরাতে ঘুমাই। ঘুমের মধ্যে কুৎসিত কুৎসিত সব স্বপ্ন দেখি। এত কুৎসিত যে ঘুমের মধ্যেই গা ঘিন ঘিন করে।
দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আমি পীর সাহেবের কাছে তোর মেয়ের কথা বিস্তারিতভাবে বলেছি উনি বলেছেন, ভয়ের কিছু নেই। দুরুদে শেফা বলে একটা দুরুদ আছে। তিনি তোকে ঐ দুরুদ এগার লক্ষবার পড়ে মেয়ের দুই চোখে ফুঁ দিতে বললেন। ফুঁ দেওয়ামাত্রই রোগ আরাম হতে শুরু করবে ইনশাল্লাহ। এই দুরুদ তোকেই পড়তে হবে, অন্যকেউ পড়লে হবে না। বুঝতে পারছিস?
হুঁ, এগার লক্ষবার একটা দুরুদ পড়া তো সহজ ব্যাপার না।
রোগটাও তত সহজ না। কাশি না যে কফ সিরাপ খাইয়ে দিবি। জটিল ব্যাধি।
এগার লক্ষবার পড়তে অনেক দিন লাগবে।
লাগলে লাগবে। তুই শুধু নিগেটিভ দিক নিয়ে ভাবছিস কেন? রাত-দিন খেটে দুরুদটা পড়ে ফেল। তারপর কোনো ইমপ্রুভমেন্ট না হলে মেয়েকে বাইরে নিয়ে যা।
আমি বাবা ওকে দ্রুত আমেরিকা নিয়ে যাব।
দুরুদ পাঠ শেষ হোক, তারপর নিয়ে যা।
আমার হাতে এত সময় নেই বাবা।
হাদিউজ্জামান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোদের সবচে বড় সমস্যা হলো বিশ্বাসের সমস্যা। তোকে দোষ দিচ্ছি না। আমরা বাস করছি অবিশ্বাসের যুগে। আইয়েমে জাহেলিয়াতের সময় যে অবিশ্বাস ছিল এখন আবার আমরা সেই অবিশ্বাসের দিকেই যাচ্ছি। বড়ই আফসোসের কথা।
দিলশাদ নরম গলায় বলল, বাবা, আমি দোয়াটা পড়ব। অবশ্যই পড়ব। কিন্তু আমি দোয়া শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করব না।
হাদিউজ্জামান বিরক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দিলশাদ নরম গলায় বলল, তুমি আমাকে এখন কিছু সাহায্য কর বাবা। আমি জানি তোমার কাছে টাকা আছে। বেশি না হলেও আছে। যা আছে তুমি আমাকে দাও। আমি তোমার প্রতিটি টাকা গুনে গুনে ফেরত দেব।
কোত্থেকে দিবি?
দরকার হলে পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করব।
নাটক নভেলের মতো কথা বলছিস কেন? বাস্তব কথা বল। ফট করে বলে ফেললি পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করবি? ভিক্ষা করা এতই সহজ?